Sunday, September 10, 2017

দূর্গা পূজার ইতিহাস

আকাশে এখন ছেঁড়া মেঘের ভেলা। শহরের
ইতিউতি কোথাও যেন কাশ ফুলের দেখা
পাওয়া। আর ভোরবেলা শিউলির ফুলের
গন্ধ। দিকে দিকে এখন দেবী বন্দনা। বছর
ঘুরে উমা দেবী আসছেন তার বাপের
বাড়ি। ঢাকের কাঠি ঢেম কুড় কুড়, ঘন্টা-
কাসার টিং টিং, মঙ্গল শাঁখ ও এয়ো
স্ত্রীর উলু ধ্বনি – মায়ের আগমনে
চারদিকে কেবল আনন্দ আয়োজন।
দুর্গোৎসব মানেই বাঙালির প্রাণের
উৎসব। জাতি- ধর্ম নির্বিশেষে সকলেই এই
আনন্দ আয়োজনে সামিল হয় বলে দুর্গা
পূজার নামকরন সার্বজনীন শারদীয়া
দুর্গোৎসব। ধনী- গরীবের ভেদাভেদ ভুলে
মন্ডপে মন্ডপে এখন আনন্দময়ীর আগমনী
স্তুতি।
শরৎকালের দুর্গোৎসব শুধু উৎসব নয়, মহা-
উৎসব। ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান,
আধ্যাত্মিকতার অনুভূতি, সংস্কৃতি,
বৈচিত্র্য, বাণিজ্য, বিদ্যাচর্চা,
সামাজিক প্রীতির বন্ধন, হাজার বছরের
বাঙালির সমন্বয় ও শান্তির ঐতিহ্যকে
প্রকাশ করে। বিশ্বজননীর পূজায় বাঙালি
হিন্দুর হৃদয়কে প্রসারিত করে সকল ধর্ম-
বর্নের মানুষকে, সকল দেশের মানুষকে
আপন করে নিতে শিখিয়ে উৎসবকে
বিশ্বজনীন উৎসবেও পরিণত করেছে।
পূজার ইতিহাস
দুর্গা পূজার ইতিহাস বেশ পুরনো।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে আছে, সৃষ্টির আদিতে
গোলকস্থ আদি বৃন্দাবনক্ষেত্রের
মহারাসমন্ডলে কৃষ্ণ সর্বপ্রথম দুর্গাপূজা
করেন। দ্বিতীয়বার দুর্গার আরাধনা করেন
ব্রহ্মা। মধু ও কৈটভ দ্বৈত্যদ্বয়ের নিধনে
তিনি শরণাপন্ন হন দেবীর। ত্রিপুরাসুরের
সঙ্গে যুদ্ধকালে সংকটাপন্ন মহাদেব
তৃতীয়বার দুর্গাপূজা করেছিলেন। এরপর
দুর্বাসা মুনির শাপে শ্রীভষ্ট হয়ে দেবরাজ
ইন্দ্র যে দুর্গাপূজা করেন। এটা চতুর্থ
দুর্গোৎসব। দেবী ভাগবত অনুসারে ব্রহ্মা ও
ইন্দ্রের ন্যায় ব্রহ্মার মানসপুত্র মনু পৃথিবীর
শাসনভার পেয়ে ক্ষীরোদসাগরের তীরে
মৃন্ময়ী মূর্তি নির্মান করে দেবী দুর্গার
আরাধনা করেন। জাগতিক মায়ার বন্ধন
থেকে মুক্তি পেতে ঋষি মান্ডব্য, হারানো
রাজ্য পুনরুদ্ধারে সুরথ রাজা ও বৈরাগ্য
লাভের জন্য সামাধি বৈশ্য,
কার্তাবির্জাজুন বধের জন্য বিষ্ণুর অবতার
পরশুরাম দুর্গার আরাধনা করেন।
কৃত্তিবাসের রামায়নে পাওয়া যায়,
রাক্ষস রাজা রাবন বিনাশে দেবী দুর্গার
শরণাপন্ন হয়েছিলেন শ্রীরামচন্দ্র। তখন
ছিল শরৎকাল। বৃহদ্ধর্মপুরাণ-এ রামের এ
অকাল বোধনের বিস্তারিত বর্ননা পাওয়া
যায়। এই পুরাণের মতে, কুম্ভকর্নের
নিদ্রাভঙ্গের পর রামচন্দ্রের অমঙ্গল
আশঙ্কায় দেবতারা শঙ্কিত হলেন। তখন
সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা জানালেন , দুর্গাপূজা
ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। ব্রহ্মা
স্বয়ং যজমানী করলেন রামের পক্ষে। তখন
শরৎকাল, দক্ষিনায়ন। দেবতাদের নিদ্রার
সময়। ব্রহ্মার স্তব-স্তুতিতে জাগ্রত হলেন
দেবী মহামায়া। তিনি উগ্রচন্ডি রুপে
আবির্ভূত হলে ব্রহ্মা বললেন, “রাবণবধে
রামচন্দ্রকে অনুগ্রহ করার জন্য তোমাকে
অকালে জাগরিত করেছি। যতদিন না রাবণ
বধ হয়, ততদিন তোমার পূজা করব। যেমন
করে আমরা আজ তোমার বোধন করে পূজা
করলাম, তেমন করেই মর্ত্যবাসী যুগ যুগ ধরে
তোমার পূজা করবে। যতকাল সৃষ্টি থাকবে,
তুমিও পূজা পাবে এইভাবেই।” একথা শুনে
চন্ডিকা বললেন, “সপ্তমী তিথিতে আমি
প্রবেশ করব রামের ধনুর্বাণে। অষ্টমীতে
রাম-রাবণে মহাযুদ্ধ হবে। অষ্টমী-নবমীর
সন্ধিক্ষণে রাবণের দশমুন্ড বিচ্ছিন্ন হবে।
সেই দশমুন্ড আবার জোড়া লাগবে। কিন্তু
নবমীতে রাবণ নিহত হবেন। দশমীতে
রামচন্দ্র করবেন বিজয়োৎসব।’’ রামচন্দ্রের
অকাল বোধনই পরে বঙ্গদেশে প্রচার পায়,
বর্তমানে যা শারদীয় দুর্গোৎসবের রুপ
নিয়েছে। মহাভারতে বর্নিত আছে,
শ্রীকৃষ্ণের রাজত্বকালে দ্বারকা নগরীতে
কুলদেবী হিসেবে দেবী দুর্গা পূজিতা
হতেন। যুদ্ধক্ষেত্রে পান্ডব পক্ষের অর্জুন ও
প্রদুন্ম দুর্গাদেবীর পূজা করেছিলেন।
দুর্গা ও দুর্গাপূজা সংক্রান্ত
কাহিনীগুলোর মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয় ও
লোকমান্য হল দেবীমাহাত্ম্যম্-এ বর্ণিত
কাহিনীটি। দেবীমাহাত্ম্যম্ প্রকৃতপক্ষে
‘মার্কন্ডেয় পুরাণ’-এর একটি নির্বাচিত
অংশ। সাতশত শ্লোকবিশিষ্ট এই
দেবীমাহাত্ম্যম্-ই শ্রীশ্রী চন্ডি গ্রন্থ।
চন্ডি পাঠ দুর্গোৎসবের একটি অবিচ্ছেদ্য
অঙ্গও বটে। দেবীমাহাত্ম্যম্-এর কাহিনী
অনুসারে পুরাকালে মহিষাসুর দেবগণকে
একশ বছর ব্যাপি এক যুদ্ধে পরাস্ত করে
স্বর্গের অধিকার কেড়ে নিয়েছিল ।
অসুরদের অত্যাচারে পৃথিবী অতিষ্ঠ হয়ে
পড়েছিল। শান্তিপুরী স্বর্গ থেকে
বিতাড়িত দেবগণ প্রথমে প্রজাপতি ব্রহ্মা
এবং পরে তাকে মুখপাত্র করে শিব ও
নারায়ণের সমীপে উপস্থিত হন।
মহিষাসুরের অত্যাচার কাহিনী শ্রবণ করে
তারা উভয়েই অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হন। সেই
ক্রোধে তাদের মুখমন্ডল ভীষণাকার ধারণ
করে। ইন্দ্রাদি অন্যান্য দেবতাদের দেহ
থেকেও সুবিপুল তেজ নির্গত হয়ে সেই
মহাতেজের সঙ্গে মিলিত হয়। সুউচ্চ
হিমালয়ে স্থিত ঋষি কাত্যায়নের আশ্রমে
সেই বিরাট তেজপুঞ্জ একত্রিত হয়ে এক
নারীমূর্তি ধারণ করল। ইনিই দুর্গা।
অপরদিকে দৈত্য, বিষ্ম, রোগ, পাপ, ভয় ও
শত্রু হতে যিনি রক্ষা করেন তিনিই দুর্গা।
আবার মার্কন্ডেয় পুরাণমতে দুর্গম নামক
অসুরকে বধ করায় দেবীর নাম হয় দুর্গা।
বাঙ্গালিরা একে দশভুজারূপে পূজা করে
থাকেন। দেবী দুর্গা মহিষাসুরকে বধের
মাধ্যমে দেবতাদের স্বর্গ ফিরিয়ে দিয়ে
শান্তির পরশ ছড়িয়ে দেন। তাই তাকে বলা
হয় দুর্গতিনাশিনী। দেবী দুর্গা শক্তির
প্রতীক হিসেবে পরিচিত। আবার দুর্গাকে
বলা হয় দুর্গতিনাশিনী, দুশভূজা, মঙ্গলময়ী,
শক্তিদায়িনী, পরমাপ্রকৃতি, আদ্যশক্তি ও
স্নেহময়ী মা। চন্ডীতে দেবীর স্তবে বলা
হয়েছে ‘স্বর্গাপবর্গদে দেবী নারায়ণি
নমোস্তুতে’। অর্থাৎ, ভোগের স্থান স্বর্গ
লাভ করার জন্য এবং মুক্তিলাভের জন্য হে
দেবী নারায়ণি, আমি তোমাকে প্রণাম
জানাই। শ্রীভগবানকে মাতৃভাবে
আরাধনার কথা মার্কন্ডেয় পুরাণে রয়েছে।
গীতাতেও ভগবান বলেছেন- আমি জগতের
মাতা। (গীতা-৯/১৭)। বাঙালি সমাজ
মায়ের ভালবাসায় মুগ্ধ। ঈশ্বর সকল জীবের
মা হয়ে বিরাজ করেন। ‘যা দেবী সর্বভূতেষু
মাতৃরূপেণ সংস্থিতা।’
দুর্গার কাঠামোগত পরিচিতি ঃ
দেবী পূজার মূল উৎস হচ্ছে সনাতন ধর্মের
আদি শাস্ত্র বেদ। অভৃশ্য ঋষির কন্যা
ব্রহ্মবাদিনী বাক সর্বপ্রথম তাঁর অতীন্দ্র
ধ্যাননেত্রে আবিষ্কার করেন দেবীসুক্ত।
এই দেবীসুক্তই হচ্ছে মাতৃবন্দনার মঙ্গলসূত্র।
শক্তি পূজার দু’টি দিক আছে একটি হলো
আধ্যাত্মিক এবং অপরটি হল আধিভৌতিক।
মাতৃসাধক আধ্যাত্মক্ষেত্রে মহামায়া
আদ্যাশক্তির আরাধনা করেন এবং অন্তরে
কাম ক্রোধাদি রিপু ও ইন্দ্রিয়দিগকে জয়
করে আধ্যাত্মিক কল্পনা ও মুক্তি লাভ
করেন। অন্যদিকে আধিভৌতিক ক্ষেত্রে
সাধক তাঁর পূজা বন্দনা করেন দেশ ও
সমাজের বাহ্য শত্রুর ও অন্ত-বিল্পবের কবল
হতে দেশ জতিকে মুক্ত করতে।
মহাশক্তি শ্রীদুর্গা দেহ দুর্গের মূল শক্তি।
আধ্যাত্মিক ভাবনা দুর্গা কাঠামোতে
অন্তর্নিহিত। দুর্গার দশহাত দশ দিক রক্ষা
করার প্রতীক, দশ প্রহরন এক দেবতার
সাধনালব্ধ বিভূতি। দেবী ত্রিভঙ্গা-
ত্রিগুণাত্মিকা শক্তির প্রতীক অর্থাৎ
সত্ত্ব,রজঃ তমঃ গুণের প্রতীক। দেবী
ত্রিনয়নী-একটি নয়ন চন্দ্রস্বরুপ, একটি
সূর্যস্বরুপ এবং তৃতীয়টি অগ্নিস্বরুপ। তাঁর
ত্রিনয়নের ইঙ্গিতেই নিয়ন্ত্রিত হয়
ত্রিকাল। দেবী সিংহবাহনা-তামসিক
পশুশক্তির অধিপতি পশুরাজ সিংহ।
মহিষাসুর-দেহস্থ প্রবল রিপুর প্রতীক। কাম,
ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য এর ঘনীভূত
মূর্তি মহিষাসুর। শিব-সর্বপুরি অধিষ্ঠিত
শিব মঙ্গল ও স্থিরত্বের প্রতীক। দেবীর
ডানপার্শ্বে উপরে লক্ষ্মী-ধনশক্তি বা
বৈশ্যশক্তির, গণেশ-ধনশক্তির বা শুদ্র
শক্তির, সরস্বতী-জ্ঞানশক্তি বা ব্রহ্মণ্য
শক্তির, কার্তিক ক্ষত্রিয় শক্তির প্রতীক।
শক্তিসমূহ অনুভূতির বিষয়, অনুভূতির আকার
নেই। আকার দেয়া হয়েছে মানুষের বোঝার
সুবিধার জন্য। সকল শক্তিই ব্রহ্মশক্তি।
সাধকের হিতার্থে ব্রহ্মের নানান রূপ
কল্পনা । তার দশ হাতে দশ রকম অস্ত্র
সুশোভিত। তার ডান হাতে ত্রিশূল, খড়গ ও
চক্র; বাম হাতে শঙ্খ, ঢাল, কুঠার, ঘন্টা।
দুর্গা দেহ-দুর্গের মহাশক্তি। সাধক
সাধনাকালে সেই শক্তিকে জাগ্রত করেন।
সেই শক্তি যখন জাগ্রত হয় তখন দেহস্থিত
রিপুসমূহ তাকে পরাজিত করে বশীভূত করার
জন্য উদ্যোগী হয়। সে সময় দেবশক্তি ও
রিপু তথা আসুরিক শক্তির মধ্যে বাঁধে
সংঘর্ষ। সেই অন্তর জগতের সংঘর্ষের একটি
প্রতীকী রুপ শ্রী শ্রী চন্ডির মাধ্যমে
রুপায়িত হয়েছে।
পূজার বর্ণনা : আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে
দুর্গা পূজা অনুষ্ঠিত হয়। প্রথানুসারে
দুর্গোৎসব কখনো পনেরো, দশ বা পাঁচ
দিনের। দুর্গা পূজার শুরু হয় মহালয়ায়। এ
দিন দেবীপক্ষের সূচনা হয়। ভোরবেলা
পিতৃতর্পনের মাধ্যমে দেবীপক্ষকে আহ্বান
জানান ভক্তরা। শোক, তাপ, দুঃখ, অমঙ্গল,
অন্ধকার হরণ করে শুভ, মঙ্গল, আনন্দদায়ক ও
আলোর দিশারী অসুরবিনাশিনী মা’কে
হিমালয় থেকে মর্ত্যে বরণ করে নিবেন
তারা। সমবেত কন্ঠের স্তব – ‘হে দেবী,
তুমি জাগো, তুমি জাগো, তুমি জাগো।
তোমার আগমনে এই পৃথিবীকে ধন্য করো ।
কলুষতা মুক্ত করো। মাতৃরুপে, বুদ্ধিরুপে,
শক্তিরুপে আশির্বাদ করো পৃথিবীর
প্রতিটি মানুষকে। বিনাশ করো আমাদের
অসুর প্রবৃত্তিকে। ’ এর ঠিক পাঁচদিন পর
মহাষষ্ঠীতে বোধন, আমন্ত্রন ও অধিবাস।
শাস্ত্রমতে, দেবীর বোধন হয় বিল্ববৃক্ষে বা
বিল্বশাখায়।
মহাসপ্তমীতে নবপত্রিকা প্রবেশ ও স্থাপন,
সপ্তম্যাদিকল্পারম্ভ, সপ্তমীবিহিত পূজা।
কদলীবৃক্ষসহ আটটি উদ্ভিদ এবং জোড়াবেল
একসঙ্গে বেঁধে শাড়ি পরিয়ে একটি বধূ
আকৃতিবিশিষ্ট করে দেবীর পাশে স্থাপন
করা হয়। এই হল ’ নবপত্রিকা’, প্রচলিত
ভাষায় যাকে ‘কলাবউ’ বলে।
মহাষ্টমীতে মহাষ্টম্যাদিকল্পারম্ভ, কেবল
মহাষ্টমীকল্পারম্ভ, মহাষ্টমীবিহিত পূজা,
বীরাষ্টমীব্রত, মহাষ্টমী ব্রতোপবাস,
কুমারী পূজা, অর্ধরাত্রবিহিত পূজা,
মহাপূজা ও মহোৎসবযাত্রা, সন্ধিপূজা ও
বলিদান। কুমারী পূজা নিয়ে একটু বলা
যাক। বৃহদ্ধর্মপুরাণের মতে, দেবী চন্ডিকা
এক কুমারী কন্যারূপেই দেবতাদের সামনে
আবির্ভূতা হয়েছিলেন। দেবী ভগবতী
কুমারীরূপেই আখ্যায়িত। কুমারী পূজার
দিন সকালে পূজার জন্য নির্দিষ্ট
কুমারীকে স্নান করিয়ে নতুন কাপড়
পরানো হয় । তাকে সাজানো হয় ফুলের
গহনা ও নানাবিধ অলঙ্কারে। পায়ে
আলতা, কপালে সিঁদুরের তিলক, হাতে
ফুলের বাজুবন্ধ, কুমারী মেয়েটি যেন
সত্যিই দেবীর প্রতিরুপ। মন্ডপে সুসজ্জিত
আসনে বসিয়ে তার পায়ের কাছে রাখা হয়
বেলপাতা, ফুল, জল, নৈবেদ্য ও পূজার
নানাবিধ উপাচার।
কুমারী দেবীর কাছে ভক্তদের মিনতি,
‘কাত্যায়নায় বিদ্মহে কন্যাকুমারী ধীমহি
তন্নো দুর্গিঃ প্রচোদয়াত্’
অর্থাৎ , হে দুর্গা, তুমি কন্যা ও কুমারী।
আমরা কাত্যায়নকে জানব। সেজন্য
তোমাকে ধ্যান করি। তুমি আমাদের শুভ
কাজে প্রেরণা দাও।
তবে সব পূজা মন্ডপে কুমারী পূজার চল
নেই। বর্তমান বাংলাদেশে ও ভারতে শুধু
রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের পূজামন্ডপগুলোতে
কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হয়। মহানবমীতে
কেবল মহানবমীকল্পারম্ভ, মহানবমী বিহিত
পূজা। বিজয়া দশমীতে বিহিত বিসর্জনাঙ্গ
পূজা, বিসর্জন, বিজয়া দশমী কৃত্য ও
কুলাচারানুসারে বিসর্জনান্তে
অপরাজিতা পূজা।
বাংলায় দুর্গোৎসবের ইতিহাস : বাংলায়
দুর্গোৎসবের প্রবর্তন কে কবে করেছিলেন,
সে সম্পর্কে সঠিক কোন তথ্য নেই।
বাংলায় যে দুর্গাপূজা প্রচলিত, তা মূলত
মহিষাসুরমর্দিনীর পূজা। মহিষাসুরমর্দিনীর
পূজার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ-এ (রচনাকাল আনুমানিক
অষ্টম শতাব্দী)। এছাড়া দুর্গাপূজার কথা
পাওয়া যায় মার্কন্ডেয় পুরাণ (মূল পুরাণটি
চতুর্থ শতাব্দীর রচনা, তবে দুর্গাপূজার
বিবরণ-সম্বলিত সপ্তশতী চন্ডী অংশটি
পরবর্তীকালের সংযোজন), বৃহন্নন্দীকেশ্বর
পুরাণ (সঠিক রচনাকাল অজ্ঞাত), কালিকা
পুরাণ (রচনাকাল ৯ম-১০ম শতাব্দী) ও বৃহদ্ধর্ম
পুরাণ-এ (রচনাকাল ১২শ শতাব্দী)। ৯ম-১২শ
শতাব্দীর মধ্যকার সময়ে নির্মিত একাধিক
মহিষাসুরমর্দিনীর মূর্তি বাংলার নানা
স্থান থেকে আবিষ্কৃতও হয়েছে।
একাদশ শতাব্দীর বাঙালি পন্ডিত ভবদেব
ভট্ট দুর্গার মাটির মূর্তি পূজার বিধান
দিয়ে গেছেন। চতুর্দশ শতাব্দীতে
মিথিলার কবি বিদ্যাপতি ‘দুর্গা ভক্তি-
তরঙ্গিণী’ ও বাঙালি পন্ডিত শূলপাণি
‘দুর্গোৎসব-বিবেক’ বই দুইটি থেকে দুর্গা
পূজার কথা জানা যায়। অর্থাৎ, চতুর্দশ
শতাব্দীতেই বাংলায় দুর্গাপূজা ছিল
রীতিমতো ‘উৎসব’। দুর্গাপূজার প্রাচীনত্ব
অনুধাবনে আরও একটি উল্লেখযোগ্য প্রমাণ
রঘুনন্দনের ‘দুর্গাপূজা তত্ত্ব’ গ্রন্থখানি।
নবদ্বীপের এই স্মার্ত পন্ডিতের লেখা
গ্রন্থটিতে দুর্গাপূজার যাবতীয় বিধান
রয়েছে। পুরাণ ও স্মৃতিশাস্ত্র থেকে প্রমান
সংগ্রহ করে পূজা পদ্ধতি লিখেছেন তিনি।
বাংলার অন্যতম প্রাচীন দুর্গাপূজা হল
পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরের
মৃন্ময়ী মন্দিরের পূজা। দেবী মৃন্ময়ী
ছিলেন মল্লভূম রাজ্যের
রাজরাজেশ্বরীমূল্ল রাজবংশের কুলদেবী।
মল্লরাজ জগৎমল্ল ৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে এই
পূজার প্রবর্তন করেন। এখানকার পূজা
পদ্ধতি বাংলায় প্রচলিত দুর্গাপূজার
থেকে অনেকটাই আলাদা; কিছুটা আলাদা
এখানকার দুর্গাপ্রতিমার গড়নও। মৃন্ময়ী
দেবী সপরিবারা বটে, কিন্তু লক্ষ্মী-গণেশ
ও কার্তিক-সরস্বতী এখানে স্থানবদল করে
থাকে। অর্থাৎ, লক্ষ্মীর স্থলে গণেশ ও
গণেশের স্থলে লক্ষ্মী এবং কার্তিকের
স্থলে সরস্বতী ও সরস্বতীর স্থলে কার্তিক।
এই রূপে দুর্গাপ্রতিমা নির্মাণের রীতিকে
জগৎমল্ল-প্রথা বলা হয়। বাঁকুড়া জেলার
অনেক প্রাচীন পরিবারেও জগৎমল্ল-প্রথায়
নির্মিত দুর্গামূর্তি পূজিত হয়। মল্ল
রাজবাড়ির পূজায় দেবী পটের যে ব্যবহার
স্বতন্ত্র। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর প্রধান শিষ্য
নিত্যানন্দ খড়দহে স্বগৃহে প্রতিমায়
দুর্গোৎসব করেছিলেন।
কোন কোন ইতিহাসবেত্তা রাজশাহীর
তাহেরপুরের রাজা কংস নারায়ণের কথা
উল্লেখ করেন। সপ্তদশ শতাব্দীর শুরুতে মুঘল
শাসনামলে বাংলার দেওয়ান রাজা
কংসনারায়ন ¯্রফে খ্যাতি লাভের
নিমিত্তে আট লাখ ব্যয়ে ঘটা করে দূর্গা
পূজা করেন। নদিয়ার ভবানন্দ মজুমদার,
বড়শিয়ার সাবর্ণ রায়চৌধুরী, কোচবিহার
রাজবাড়ি সর্বত্রই মহাসমারোহে
দুর্গোৎসবের আয়োজন করেন। তাই বলা যায়,
সপ্তদশ শতাব্দীতেই দুর্গোৎসবের সূচনা।
ঢাকার দুর্গোৎসবের ইতিহাস খুব পুরনো নয়।
অর্থনীতিবিদ ভবতোষ দত্তের আত্মজীবনী
থেকে জানা যায়, ১৮৩০ সালে সূত্রাপুরে
নন্দলাল বাবুর মৈশুন্ডির বাড়িতে ঘটা করে
আয়োজন করা হয় দুর্গা পূজার। দোতলা
বাড়ির সমান উঁচু ছিল সে প্রতিমা। বিশ
শতকের শুরুতে দুর্গা পূজা ছিল
পারিবারিক। জমিদার বা ধনাঢ্য
ব্যবসায়ীরা সে কালে পূজার আয়োজন
করতেন। ত্রিশের দশকে শুরু হয় বারোয়ারি
পূজা। আর্থিকভাবে স্বচ্ছল ব্যক্তিরা
সম্মিলিতভাবে পূজা করতেন। প্রথমদিকে
কেবল বাবুগিরি ও ইংরেজদের সঙ্গে
সদ্ভাব বজায় রাখার জন্যই পালিত হতো এ
উৎসব। বাবুদের সামাজিক মর্যাদা লাভের
উপায়ও ছিল এ উৎসব! পূজায় ইংরেজদের
আপ্যায়নের জন্য থাকত ব্রান্ডি, শেরি,
শ্যাম্পেন। থাকত আমোদ-প্রমোদের
সুব্যবস্থার অংশ হিসেবে বাইজি নাচ,
কবিগান, চরস ও তামাকের ধোঁয়াও।
১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর দুর্গা পূজা
হয়ে যায় সর্বসাধারণের উৎসব, তখন পূজা
পালনে আসে ভিন্নতা। দেশভাগের পর
বাংলাদেশে এককভাবে পূজা করাটা বেশ
ব্যয়সাপেক্ষ হয়ে উঠে। ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণ
নির্বিশেষে মিলেমিশে পূজা করার চল শুরু
হয়। তবে এখনও পারিবারিক পূজার চল রয়ে
গেছে বাংলাদেশের অনেক এলাকায়।
পাকিস্তানি শাসনামলেও পূজার আনন্দে
ভাটা পড়ে নি। এ সময়ের পূজার স্মৃতিচারন
করেন মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির
সভাপতি বাসুদেব ধর। স্মৃতি রোমান্থন
করতে গিয়ে তিনি চলে যান সত্তরের
দশকের দিনগুলোতে। তিনি জানান ‘পূজা শুরু
হত মহালয়া থেকে। মহালয়ার ভোরে সে
কি ধুম ! ভোরে রেডিও আকাশবানী-তে
কৃষ্ণ ভদ্রের দরাজ গলায় ‘ মহালয়া’ শুনতাম
পরিবারের সবাই মিলে। সে আসরের জন্য
কত কি আয়োজন ! সে দিন গেছে । তখন
প্রতিমার নির্মানের খরচ ছিল খুব কম।
প্রতিমার সাজ সজ্জা ছিল সাধারন।
ভ্যানে বা নৌকায় করে প্রতিমা আসত
বাড়িতে। মায়েরা প্রতিমা বরণ করে
নিতেন। এ গ্রাম,ও গ্রাম ঘুরে ঘুরে পূজা
দেখতাম। অষ্টমী বা নবমীর সন্ধ্যায় হত
আরতি প্রতিযোগিতা। ঢাকের ঢেম কুড় কুড়
ছড়িয়ে পড়ত গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। ’
স্বাধীনতা অর্জনের পর ঢাকেশ্বরী
মন্দিরে শুরু হয় কেন্দ্রীয় দুর্গাপূজা।
কিছু ঐতিহ্য সবসময়ই অমলিন। পূজা
উপলক্ষে এখনও মেলা বসে। নাগরদোলা,
গজা-মুরালি-সন্দেশের দোকান, আলো
ঝলমলে পূজার মন্ডপগুলো, মাইকে গান এসব
এখনও চোখে পড়ে। স সারাদিনজুড়ে
ঢাকিদের সমাগম, ভক্তদের ভিড়,
পুরোহিতদের হাতে ভক্তের প্রসাদ গ্রহণ,
সন্ধ্যায় আরতি ও নৃত্য, সব মিলিয়ে উৎসবের
ছোঁয়ার কমতি নেই কোথাও। দিন
পাল্টেছে, উৎসবে হয়তো নতুন মাত্রা যোগ
হয়েছে। কিন্তু উৎসবের এই চিরাচরিত রুপ
বদলায় নি এতটুকু।
পূজোর সাজ পোশাকেও সেকেলে ভাবটা
থেকে গেছে। পূজা মানেই পাড়ার দিদি-
বৌদিদের এক প্যাঁচে পরা গারদের শাড়ি।
লাল পেড়ে সাদা শাড়ি, আলতা রাঙা
পায়ে নূপূর পড়ে পূজা মন্ডপে আসবেন
তারা। ধূতি- সাদা পাঞ্জাবি উঠে যায়
নি, বরং পরনের ধরনে এসেছে নানা
বৈচিত্র্য। পূজার নৈবদ্যেও পুরনো ধারা
বজায় রেখেছে ভক্তরা। মৌসুমী ফলের
ভোগের পাশাপাশি খিঁচুড়ি প্রসাদ,
মিষ্টান্ন কি বাঙালি সহজে ভুলে! তারপর
রয়েছে মন্ডা- মিঠাই, মুড়ি- মুড়কি।
পূজা মানেই বাড়ি জুড়ে আনন্দের ধুম।
পূজার পাঁচদিন বাড়িতে রান্না হবে
বাহারি পদের সব আইটেম। প্রথা অনুযায়ী
ষষ্ঠী থেকে নবমী এ চারদিন চলবে
নিরামিষ। ষষ্ঠীর সকালে মায়েরা
বানাবেন লুচি ও বেগুন ভাজি। দুপুরের জন্য
রান্না হবে আলু- পটলের ঝোল, তেতুল বা
টমেটোর টক, মিষ্টি কুমড়ো ভাজি, মুগডাল
ও বিভিন্ন পদের সবজি মিলিয়ে লাবড়া।
সপ্তমীর দিন সকালের মেন্যু একই।
অঞ্জলির পর এসে দেখবো মা রান্না
করেছেন আমার পছন্দের ভুনা খিচুড়ি,
টমেটোর চাটনি। এ ছাড়াও রান্না হবে
আলু-পনিরের রসা, লাবড়া, বেগুন ভাজি।
নবমীর দিনে একটু বৈচিত্র্য আনতে বিভিন্ন
পদের সবজির আইটেম রান্না হবে। সাথে
তো ভুনা খিচুড়ি থাকছেই, আর রান্না হবে
মিষ্টান্ন। দশমীর দিনে ফের আমিষ। এদিন
বাড়িতে পোলাও, কোরমা, রুই মাছের
কালিয়া রান্না হবে।
মা ফিরবেন কৈলাসে …. : বিজয়া দশমী।
পাঁচ দিনব্যাপী শারদীয় দুর্গোৎসবের
শেষ দিন। দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গা
মর্ত্যলোক ছেড়ে স্বর্গ শিখর কৈলাসে
স্বামীগৃহে ফিরে যাবেন। পেছনে ফেলে
যাবেন ভক্তদের শ্রদ্ধা আর বেদনাশ্রু।
সকালেই দেবীর দশমীবিহিত পূজা সমাপন
ও দর্পণ বিসর্জনের পর্ব শেষ হবে। প্রতিমা
বিসর্জনের আগে এয়ো স্ত্রীরা দেবী
দুর্গাকে বেদনাবিধূর বিদায়লগ্নে তেল,
সিঁদুর ও পান দিয়ে মিষ্টিমুখ করাবেন।
এরপর শোভাযাত্রা সহকারে দেবী
প্রতিমা বিসর্জনে চলবে ভক্তরা।
শোভাযাত্রা শেষে মন্দিরে ফিরে
শান্তিজল ও আশির্বাদ গ্রহণ করে ঘরে
ফিরবেন ভক্তরা।
দুর্গাপূজা হলো অশুভ, অন্যায়, পাপ,
পঙ্কিলতার বিরুদ্ধে ন্যায়, পূর্ণ, সত্য, শুভ ও
সুন্দরের যুদ্ধ। দুর্গতি থেকে রক্ষা, বিভেদ,
বিবাদ, অনৈক্য, সাম্প্রদায়িকতা,
ক্ষুদ্রস্বার্থবোধ ও সংকীর্ণতা প্রভৃতির
ঊর্ধ্বে ওঠার জন্য মহাশক্তির বর লাভের
নিমিত্তে সনাতন ধর্মাবলম্বরী মেতে
উঠবেন দেবী বন্দনায়। আত্মশক্তির উত্থান,
প্রাণশক্তির জাগরণ, ষড়রিপুর গ্রাস থেকে
ম্ুিক্তর জন্য আদ্যাশক্তি মহামায়ার
কৃপালাভের জন্য দুর্গাদেবীর আরাধনায়
মেতে উঠবে বিশ্ব চরাচর। দেবীর চরণে
ভক্তদের কাতর মিনতি- এবারের দুর্গোৎসব
যেন সামাজিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করে
সৌহার্দ্য, হিংসা, বিদ্বেষ, কলুষতামুক্ত
ভালোবাসার স্পন্দনে মথিত, গৌরাবান্বিত
করে তুলেন সবাইকে।
রবীন্দ্রনাথ তাই তাঁর গানে বাঙালি
জাতির হাজার বছরের হৃদয়ে লালিত
প্রাণের কথাটিই লিখেছিলেন
শস্যখেতের সোনার গানে যোগ দে রে আজ
সমান তানে,
ভাসিয়ে দে সুর ভরা নদীর অমল জলধারে।
যে এসেছে তাহার মুখে দেখ্ রে চেয়ে
গভীর সুখে,
দুয়ার খুলে তাহার সাথে বাহির হয়ে যা
রে।।
শরতে আজ কোন্ অতিথি এল প্রাণের
দ্বারে।
আনন্দগান গা রে হৃদয়, আনন্দগান গা রে।।

No comments:

Post a Comment

একটি " জগন্নাথপুর শিক্ষা ফাউন্ডেশন"

জগন্নাথপুর শিক্ষা ফাউন্ডেশন একটি অলাভজনক সেবা প্রতিষ্টান। উক্ত গ্রামের হতদরিদ্র ছাত্রছাত্রীদের বিনা খরচে শিক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা ও আর্...