তেজ
দেবব্রত সিংহ
মু জামবনির কুঁইরি পাড়ার শিবু কুঁইরির বিটি সাঁঝলি বটে।’কাগজওয়ালারা বইললেক,“উঁ অতটুকু বইললে হবেক কেনে?তুমি এবারকার মাধ্যমিকে পত্থম হইছ।তোমাকে বইলতে হবেক আরো কিছু।”পঞ্চায়েতের অনি বৌদি, পধান, উপপধান, এইমেলে, এম.পি-সব একেবারে হামলিয়ে পড়ল আমাদের মাটির কুঁইড়েঘরে।জামবনি ইস্কুলের হেডমাস্টারকোন বিহান বেলায় টিনের আগর খুইলে,হেইকে, ডেইকে, ঘুম ভাঙাই- খবরটা যখন পথম শুনালেকতখন মাকে জড়াই শুয়ে ছিলুম আমি।কুঁড়াঘরের ঘুটঘুইটা আঁধারে হেডমাস্টার মশাইরে দেইখেচোখ কচালে মায়ের পারা আমিও হাঁ – হয়ে ভাইবে ছিলেম।-একি স্বপন দেখছি নাকি-স্যার বইলল, এটা স্বপুন লয়, স্বপুন লয়, সত্যি বইটে।কথাটো শুইনে কেঁইনদে ভাসায়েছিলুম আমরা মা বিটি।আজ বাপ বেঁইচে থাইকলেআমি মানুষটাকে দেখাইতে পাইত্থম। দেখাইতে পাইতত্থেম বহুত কিছু-আমার বুকের ভিতরযে তেজালো সইনঝা বাতিটা জ্বালায়ে ছিল মানুষটা।সেই বাতিটা আজকে কেমন আমাদের কুঁইড়ে ঘরটাকে আলো কইরেছে।সেটো দেখাইতে পাইত্থম।আপনারা বইলছেন বটে“তুমাদের মতো মেইয়ারা যদি উঠে আসে তবে ভারতবর্ষ উঠে আসে।”কথাটা খুবই সত্যি, কিন্তুউঠে আসার রাস্তাটা যে এখোন তৈয়ার হয় নাই।খাড়া পাহাড়ে উঠা যে কি জিনিস।বহুত দম লাগে। বহুত ত্যাজ লাগে…আমি জামবনির কুঁইরি পাড়ার শিবু কুঁইরির বিটি সাঁঝলি।যখন থেকে হুঁশ হইছে তখন থেকে শুইনে আসছি“বিটি না মাটি’ঠাকুমা বইলথক্,পরের ঘরে হেঁইসেল ঠেইলবেক্ তার আবার লিখাপড়া’গাঁয়ের বাবুরা বইলথক্“দ্যাখ সাঁঝলি – মন খারাপ কইরলি তো হেইরে গেলি।শুন যে যা বইলছে বলুক্। সে সব কথা এক কানে সিধালেআর এক কানে বার কইরে দিবি।’তখ্যান বাবুপাড়ার দেঘইরা ঘরে কামিন খাইটতক মা।ক্ষয় রোগের তাড়সে-মায়ের গতরটা ভাঙে নাই অতোটা।মাঝে মইধ্যে জ্বরটর আইত বটে, জ্বর এলে মাচুপচাপ এঙনাতে তালাই পাইতে শুইয়ে থাইকতো।মনে আছে সে ছিল এক জাঁড় কালের সকাল।রোদ উঠেছিল ঝলমলানি ঝিঙা ফুলা রোদ।আমি সে রোদে পিঠ দিয়া গা দুলাই পড়ছিলামইতিহাস…কেলাস সেভেনের সামন্ত রাজাদের ইতিহাস।দে ঘরের গিন্নি লোক পাঠাইছিল বারকতক।মায়ের জ্বর সে তারা শুইনতে নাই চায়!আমাদের দিদি বুঢ়ি তখনো বাঁইচে।ছেঁড়া কম্বল মুড়হি দিয়ে বিড়ি ফুকছিল বুড়হি।শেষতক্ বুড়হি সেদিন পড়া থেকে উঠাইমায়ের কাইজ টুকুন কইরতে পাঠাই ছিল বাবু ঘরে।পুরানো ফটক ঘেরা উঠান-অতোবড়ো দরদালান- অতোবড়ো বারান্দা,সব ঝাঁট ফাট দিয়ে সাফ সুতরো করে আসছিলুম চইলে,দেঘইরে গিন্নি নাই ছাইড়ল্যাক, একগাদা এটাকাটা-জুঠা বাসনআমার সামনে আইনে ধইরে দিলেক। বইল্লুম“আমি তোমাদের জুঠা বাসন ধুইতে লাইরবো,”বাবু গিন্নির সেকি রাগ’-“কি বইল্লি তুই যতবড়ো মু লয় তত বড়ো কথা? জানিস,তর মা, তর মায়ের মা, তার মায়ের মা সবাই এতক্কালআমাদের জুঠা বাসন ধুয়ে গুজারে গ্যালোআর তুই আমাদের জুঠা বাসন ধুইতে লাইরবি!”বল্লুম “হ আমি তোমাদের জুঠা বাসন ধুইতে লাইরবো।তোমরা লোক দেখে লাওগা। আমি চইল্লোম”কথাটো বইলে গটগট গটগট কইরে বাবু গিন্নির মুখের সামনেআমি বেড়োই চইলে আইলম।”তা বাদে সে লিয়ে কি কাইন্ড। কি ঝাম্যালা।বেলা ডুবলে মাহাতোদের ধান কাট্টে বাপ ঘরে ফিরে আইলেদুপাতা লিখাপড়া করা লাত্নির ছোট মুখে বড়ো থুতির কথাসাতকাহন কইরে বইলেছিল বুড়হি দিদি।মা কুনো রা কাড়ে নাই।আঘর মাসের সইন্ ঝা বেলাই এঙ্গ্নাতে আগুন জ্বেইলেগা-হাত-পা সেঁকছিল মা।একমাথা ঝাঁকড়া চুল ঝাঁকানো বাপের পেটানো পাথরের মুখটাঝইলকে উঠেছিল আগুনের আঁচে।আমি বাপের অমুন চেহারা কুনোদিন দেখি লাই।বাপ সেদিন মা আর দিদি বুড়ির সমুখে আমাকে কাইছে ডেইকেমাথায় হাত বুলাই গম্ গইমা গলায় বইলেছিল –যা কইরেছিস্! বেশ্ কইরেছিস্।শুন্, তর মা, তর মায়ের মা, তার মায়ের মা- সবাই কইরেছে কামিনগিরি।বাবুঘরে গতর খাটাই খাইয়েছে। তাইতে হইছে টা কি।তাতে হইছে টা কি! ই-কথাটো মনে রাখবি সাঝ্লি,তুই কিন্তু কামিন হবার লাগে জম্মাস লাই।যত বড় লাট সাহেবই হোক কেনে কারু কাছে মাথা নোয়াইনিজের ত্যাজ বিকাবি লাই।এই ত্যাজ টুকুর ল্যাইগে লিখাপড়া শিখাচ্ছি তুকে।না হলে আমাদের মতো হা-ভাতা মানুষের ঘরে আর আছে টা কি?”আমি জামবনির কুইরি পাড়ার শিবু কুইরির বিটি সাঁঝলি,কবেকার সেই কেলাস সেভেনের কথা ভাবতে যায়েকাগজওয়ালা টিভিওয়ালাদের সামনে এখুন কি যে বলি…তালপাতার রদ দিয়ে ঘেরা গোবুর লতার এঙ্গনাতে লুকে এখন লুকাকার।তার মাঝে বাঁশি বাজাই, জিপগাড়িতে চেইপেআগুপিছু পুলিশ লিয়ে মন্ত্রী আইল্যাক ছুটে।‘কুথায় সাঁঝলি কুইরি কুথায়’, বইলতে বইলতেবন্দুকধারী পুলিশ লিয়ে সুজা আমাদের মাটির কুইড়ে ঘরে,হেডমাস্টার বইললে ‘পনাম কর, সাঁঝলি পনামকর’মন্ত্রী তখন পিঠ চাপড়াইল্যাক। পিঠ চাপরাই বইল্লেক,“তুমি কামিন খেইটে মাইধ্যমিকে পথম হইছ,তাই তুমারে দেইখতে আইলম্, সত্যিই বড় গরীব অবস্থা বটে।তুমাদের মতো মিয়ারা যাতে উঠে আসেতার লাগেই তো আমাদের পার্টি, তার লাগেই তো আমাদের সরকার।– এই লাও, দশ হাজার টাকার চেকটা এখুন লাও।শুন আমরা তুমাকে আরো ফুল দিব, সম্মর্ধ্বনা দিব,আরো দ্যাদার টাকা তুলে দিব।–এই টিবির লোক, কাগুজের লোক, কারা আছেন, ই-দিকে আসেন।“তক্ষুনি ছোট বড় কতরকমের সব ঝইলকে উঠল ক্যামেরা,ঝইলকে উঠল মন্ত্রীর মুখ। না না মন্ত্রী লয়, মন্ত্রী লয়,ঝইলকে উঠল আমার বাপের মুখ।গন্ গনা আগুনের পারা আগুন মানুষের মুখ।আমি তক্ষুনি বইলে উঠলম-“না না ই টাকা আমার নাই লাইগব্যাক। আর আপনারাযে আমায় ফুল দিব্যান, সম্মর্ধ্বনা দিব্যান বইলছেন তাও আমার নাই লাইগব্যাক।’মন্ত্রী তখন ঢোক গিলল্যাক।গাঁয়ের সেই দেঘইর্যা গিন্নির বড় ব্যাটা এখুন পাটির বড় ল্যাতা।ভিড় ঠেলে সে আইসে বইলল্যাক-“ ক্যানে, কি হইছেরে সাঁঝলি,তুই তো আমাদের বাড়ি কামিন ছিলি।বল তর কি কি লাইগব্যাক, বল, তর কি কি লাইগব্যাক খুলে বল খালি,”বইল্ লম –“ আমার পারা শয়ে শয়ে আর অনেক সাঁঝলি আছে।আর শিবু কুইরির বিটি আছে গাঁ গিরামে। তারা যদ্দিনঅন্ধকারে পইড়ে থাইকবেক তারা যদ্দিন লিখ-পড়ার লাগে কাঁইদে বুলব্যাক্।তদ্দিন কুনো বাবুর দয়া আমার নাই লাইগব্যাক্। শুইনছ্যান আপনারাতদ্দিন কুনো বাবুর দয়া আমার নাই লাইগ্ ব্যাক।“
Saturday, September 23, 2017
তেজ - দেবব্রত সিংহ
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
একটি " জগন্নাথপুর শিক্ষা ফাউন্ডেশন"
জগন্নাথপুর শিক্ষা ফাউন্ডেশন একটি অলাভজনক সেবা প্রতিষ্টান। উক্ত গ্রামের হতদরিদ্র ছাত্রছাত্রীদের বিনা খরচে শিক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা ও আর্...
-
আর পারছি না গুরু তেইশটা বছর ধরেপ্যান্টে শার্ট গুজে পরে আর পারছিনা গুরুসেই নার্সারি থেকে শুরু। পাড়ার যত ছেলেগুলোসবার ঘরে বউ এল মা বললেন ম...
-
বাসর ঘরে ঢুকতেই বউ আমাকে নমস্কার জানালো।আমিও নমস্কার উত্তর শুনে পাশে গিয়ে বসলাম। পাশে বসতেই বৌ আমাকে বলল.... ----ঘড়িতে তাকিঁয়ে দেখুন তো...
-
আকাশে এখন ছেঁড়া মেঘের ভেলা। শহরের ইতিউতি কোথাও যেন কাশ ফুলের দেখা পাওয়া। আর ভোরবেলা শিউলির ফুলের গন্ধ। দিকে দিকে এখন দেবী বন্দনা। বছর ঘু...
No comments:
Post a Comment