Sunday, September 24, 2017

পাছে লোকে কিছু বলে - কামিনী রায়

কবি কামিনী রায় লিখেছিলেন - “করিতে পারি না কাজ, সদা ভয়, সদা লাজ, সংশয়ে সংকল্প সদা টলে, পাছে লোকে কিছু বলে/ আড়ালে আড়ালে থাকি, নীরবে আপনা ঢাকি সম্মুখ চরণ নাহি চলে, পাছে লোকে কিছু বলে/ হৃদয়ে বুদবুদ-মত উঠে চিন্তা কত মিশে যায় হৃদয়ের তলে, পাছে লোকে কিছু বলে/ কাঁদে প্রাণ যবে, আঁখি সযতনে শুষ্ক রাখি নির্মল নয়নের জলে, পাছে লোকে কিছু বলে/ মহৎ উদ্দেশে যবে একসাথে মিলে সবে, পারি না মিলিতে সেই দলে/ বিধাতা দিয়েছেন প্রাণ, থাকি সদা ম্রিয়মান, শক্তি মরে ভীতির কবলে, পাছে লোকে কিছু বলে।” পৃথিবীতে এমন কোন মানুষ নেই যার মধ্যে মঙ্গল চিন্তার উদয় হয় না। কিন্তু মঙ্গল চিন্তাকে মানুষ কর্মের মাধ্যমে বাস্তবায়িত করতে পারেনা লোকভয়ে। ফলে ব্যক্তিত্ব যেমন বিকশিত হয় না তেমনি সমাজও বঞ্চিত হয় কল্যাণকর উদ্যোগ থেকে।“পাছে লোকে কিছু বলে” - এক আত্মঘাতী মনোভাব। এই আত্মঘাত থেকে মুক্তির একটাই উপায় অন্য কারো দোষ ত্রুটির দিকে দৃষ্টি না দেয়া। মানুষ বড়ই অদ্ভুদ আচরণ করে। সে কখনও তার প্রিয় বন্ধুর সামনা সামনি সমালোচনা করে না। অথচ প্রিয় বন্ধুর আড়ালে তার দোষের কথা বলতে বাধে না। কিন্তু বন্ধুর প্রতি একটু ভালবাসা থাকলে ভালবাসার দাবী হলো, যাকে ভালবাসি তাকে সংশোধনে সহযোগীতা করা। কোমলতা ও প্রেমের সাথে এমনভাবে তার দোষগুলো দেখিয়ে দেয়া যেন সে সংশোধনের সুযোগ পায়। বন্ধু কখনও অন্যের কাছে বন্ধুর দোষ বলতে পারে না বা শুনতে পারে না।এই কাজটা ভালো ঐ কাজটা মন্দ এটা নির্ধারণ করে কে? এই কাজটি করা উচিত ঐ কাজটি করা উচিত নয় কে এই রায় দেয়? উচিত হলে কাজটি করা যাবে অনুচিত হলে করা যাবে না এমন বাধ্যবাধকতা কে আরোপ করে? ভালো-মন্দ নিয়ে বিতর্ক চলে আসছে অনাদি কাল থেকে। ভাল-মন্দ কাকে বলে? কীভাবে আমরা বুঝি কোন্ কাজটি ভাল আর কোন্ কাজটি মন্দ?পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পরিবেশ আমাদের মধ্যে ভালো মন্দের একটি চিত্র তৈরি করে। মনস্তাত্বিকভাবেআমরা সেই চিত্রের মতো হতে চাই। কিন্তু পারি না। আমাদের দৃষ্টিতে মন্দকর্মগুলোকে আমরা ভুল, খারাপ, পাপ ইত্যাদি নানা নামে ডাকি। আমাদের দৃষ্টিতে যা ভালো তা না করে যখন নিজেরাই মন্দ কিছু করে ফেলি তখন সৃষ্টি হয় আত্মগ্লানি ও হতাশার।আমার বিবেক যা করার জন্য সায় দিয়েছে আমি তা করেছি, যা বলার ছিল, বলেছি। যা কিছু আমরা অতীতে করেছি তার কোনকিছুকে পরিবর্তন করার সাধ্য আমাদের নেই। যা করেছি করেছি, এজন্য দুঃখ কিংবা অনুতাপ করে নিজের ক্ষতি ব্যতীত লাভ কিছু হয় না। তবুও ভলো-মন্দের যুদ্ধ থেকে আমাদের পরিত্রাণ নেই। নিজের ভিতরে ভালো-মন্দের যুদ্ধ চলছে তো চলছেই। আমার কাছে যা ভালো তা আমার দৈহিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। আমার কাছে যা মন্দ তা আমার মানসিক ও দৈহিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তবু আমি লোকের অনুমোদন চাই। মানুষের কাছ থেকে আমার কৃত কর্মের অনুমোদন আশা করলে হতাশা তো আসবেই। শান্তি পেতে হলে এসব অমূলক আশা-হতাশা ত্যাগ করতেই তো হবে।কিছু মানুষ আছে যারা ভাল-মন্দ নির্ণয় করে শাস্ত্র থেকে। শাস্ত্রে লিখা আছে এই কাজটি মন্দ সুতরাং তা মন্দ এই হলো তাদের একমাত্র যুক্তি। অন্যদের মতে - মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতা ততক্ষণ পর্যন্ত সমর্থিত যতক্ষণ পর্যন্ত তা অন্য মানুষের ক্ষতির কারণ না হয়। কোন মানুষের কাজ সামাজিক শান্তি ও শৃঙ্খলার জন্য হুমকি না হলেতাকে বাধা দেয়া যায় না। যে যা খুশি করতে পারে কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে তা যেন অন্যের ক্ষতি না করে। অন্যের ক্ষতি না হওয়া পর্যন্ত সব কাজই ব্যক্তি ইচ্ছে করলে করতে পারে। আবার, কিছু মানুষের মানদন্ড হচ্ছে সমাজ। সমাজ যাকে ভাল বলে তাই ভালো আর সমাজ যাকে মন্দ বলে তাই মন্দ। মানুষ সমাজবদ্ধ জীব তাই সমাজ রক্ষার স্বার্থেতাকে সামাজিক রীতি-নীতি মেনে চলতে হয়। তাই সমাজে চালুকৃত প্রথাই অনেকের কাছে ভালো-মন্দের মানদন্ড। সমাজেরকাছে কোন কাজ মন্দ বা অনুচিত বলে বিবেচিত হলে তা অনুচিত। অনেক সময় শাস্ত্রীয় রীতি-নীতিও সমাজের রীতি-নীতিহয়। যাই হোক সমাজের বেশিরভাগ মানুষ যা করছে আমাকেও তা-ই করতে হবে তা না হলেই ‘পাছে লোকে কিছু বলে’ ভয় আমাকে তাড়া করে।এক একটা সমাজের রীতি-নীতি এক এক রকমের। এক সমাজের রীতি-নীতি অন্য সমাজে অচল। এক সমাজের মানদন্ডে অন্য সমাজকে বিচার করা যায় না। অতীতের মানদন্ড দিয়ে যেমন বর্তমানের বিচার করা যায় না তেমনি আরবের মানদন্ড দিয়ে বাংলাদেশের বিচার করা যায় না। এক সমাজের রীতি-নীতিকে অন্য সমাজের রীতি-নীতি থেকে ভালো বা মন্দ বলা যায় না।অনেকের মতে বিবেকই ভালো-মন্দ নির্ধারণের মানদন্ড। তাদের মতে মানুষের মধ্যে এমন একটি শক্তি আছে যা তাকে ভালো কাজ করতে বলে এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকতে বলে। এই শক্তিকে আমরা বলি বিবেক। কিন্তু নিজের মধ্যে অনুসন্ধান করলে উপলব্ধিতে আসে - বিবেকও গঠিত হয় শাস্ত্র পাঠ, শুনা কথা ও সামাজিক রীতি-নীতির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায়। বিবেক ভালোকে ভালো এবং মন্দকে মন্দ বলার আগে তার মানদন্ড তৈরী করে। মানুষের বিবেক স্থান ও কাল ভেদে সব সময় সঠিক সিদ্ধান্ত দিতে পারে না। হঠাৎ করে একজন বাঙালি আমেরিকা গেলে তার বিবেকের কার্যকারীতাহারিয়ে ফেলে। কোন ব্যক্তি নিজের বিবেকের সিদ্ধান্ত অন্য কোন ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা সমাজের উপর চালিয়ে দিতে পারে না। এমন যুক্তি দিয়ে কেউ পার পেতে পারে না যে, আমার বিবেক বলেছে, তাই করেছি। নিজের বিবেকের সিদ্ধান্তঅনুযায়ী মানুষ অন্য ব্যক্তির কর্মের মূল্যায়ন করতে পারে না। দুই ব্যক্তির মধ্যে কোন বিষয়ে দ্বন্দ্ব সৃষ্টিহলে কার বিবেকের সিদ্ধান্ত সঠিক এ বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত নেয়া যায় না। আবার মানুষের বিবেকই অভ্যাসের বশবর্তীহয়ে মন্দকে ভালো এবং ভালোকে মন্দ হিসেবে গ্রহণ করে। বিবেকের আহ্বান শুনলে যদি নিজের কোন পার্থিব ক্ষতির কারণ হয় তাহলে মানুষ যুক্তি দিয়ে বিবেককেও প্রভাবিত করতে পারে। বাস্তবে অধিকাংশ মানুষই বিবেকের নির্দেশে নিজের ক্ষতি করে অন্যের ভাল করে না। বাস্তবে মানুষ মন্দ কাজ থেকে যতটুকু বিরত থাকে তা আইনের ভয়ে। আর আইনেরসীমাবদ্ধতা হলো, আইন কেবল অন্য মানুষের অধিকারে হস্তক্ষেপ করলেই প্রয়োগ হতে পারে। নিজের সাথে নিজে মিথ্যাচার করলে, নিজের সাথে নিজে অঙ্গীকার ভঙ্গ করলে, নিজের সম্পদ নিজে নষ্ট করলে আইন কিছু করতে পারে না। ভালো মানুষ তৈরি করা আইনের উদ্দেশ্য নয়। আইনের উদ্দেশ্য হচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তা। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়াপর্যন্ত আইন কিছু করতে পারে না। আইন মানুষের ঘরে কিংবা নির্জনে পুলিশী পাহাড়া বসাতে পারে না। ভালো-মন্দ নির্ণয়ের এই জটিলতা থেকেই উপলব্ধিতে আসে একজন ভালো বন্ধুর প্রয়োজনীয়তা।ভালোমন্দ নির্ণয় করতে হলে বন্ধুর প্রতি থাকতে হবে প্রেম, শ্রদ্ধা, ভক্তি ও বিশ্বাস। বন্ধুর আদেশ, উপদেশ, নিষেধের প্রতি শ্রদ্ধা, ভক্তি এবং বিশ্বাসই পারে মানুষকে ভালো-মন্দের সঠিক নির্দেশনা দিতে। যে কর্মের মাধ্যমে বন্ধুর সন্তুষ্টি অর্জিত হয় তা ভালো, যে কর্মের মাধ্যমে বন্ধু অসন্তুষ্ট হন তা মন্দ। বন্ধুত্বের অভিধানেএই হলো ভালো-মন্দের সংজ্ঞা।বন্ধুর কাছে মূল্যায়নের একমাত্র মানদন্ড হচ্ছেন বন্ধু। সারা পৃথিবী আমার বিরুদ্ধে চলে যাক্, সব মানুষ আমার সমালোচনা করুক তাতে কী!  বন্ধু সন্তুষ্ট হলে আমিও সন্তুষ্ট হবোো ।

সমাজে বন্ধুত্বের জয় হোক



No comments:

Post a Comment

একটি " জগন্নাথপুর শিক্ষা ফাউন্ডেশন"

জগন্নাথপুর শিক্ষা ফাউন্ডেশন একটি অলাভজনক সেবা প্রতিষ্টান। উক্ত গ্রামের হতদরিদ্র ছাত্রছাত্রীদের বিনা খরচে শিক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা ও আর্...