Sunday, September 24, 2017

পাছে লোকে কিছু বলে - কামিনী রায়

কবি কামিনী রায় লিখেছিলেন - “করিতে পারি না কাজ, সদা ভয়, সদা লাজ, সংশয়ে সংকল্প সদা টলে, পাছে লোকে কিছু বলে/ আড়ালে আড়ালে থাকি, নীরবে আপনা ঢাকি সম্মুখ চরণ নাহি চলে, পাছে লোকে কিছু বলে/ হৃদয়ে বুদবুদ-মত উঠে চিন্তা কত মিশে যায় হৃদয়ের তলে, পাছে লোকে কিছু বলে/ কাঁদে প্রাণ যবে, আঁখি সযতনে শুষ্ক রাখি নির্মল নয়নের জলে, পাছে লোকে কিছু বলে/ মহৎ উদ্দেশে যবে একসাথে মিলে সবে, পারি না মিলিতে সেই দলে/ বিধাতা দিয়েছেন প্রাণ, থাকি সদা ম্রিয়মান, শক্তি মরে ভীতির কবলে, পাছে লোকে কিছু বলে।” পৃথিবীতে এমন কোন মানুষ নেই যার মধ্যে মঙ্গল চিন্তার উদয় হয় না। কিন্তু মঙ্গল চিন্তাকে মানুষ কর্মের মাধ্যমে বাস্তবায়িত করতে পারেনা লোকভয়ে। ফলে ব্যক্তিত্ব যেমন বিকশিত হয় না তেমনি সমাজও বঞ্চিত হয় কল্যাণকর উদ্যোগ থেকে।“পাছে লোকে কিছু বলে” - এক আত্মঘাতী মনোভাব। এই আত্মঘাত থেকে মুক্তির একটাই উপায় অন্য কারো দোষ ত্রুটির দিকে দৃষ্টি না দেয়া। মানুষ বড়ই অদ্ভুদ আচরণ করে। সে কখনও তার প্রিয় বন্ধুর সামনা সামনি সমালোচনা করে না। অথচ প্রিয় বন্ধুর আড়ালে তার দোষের কথা বলতে বাধে না। কিন্তু বন্ধুর প্রতি একটু ভালবাসা থাকলে ভালবাসার দাবী হলো, যাকে ভালবাসি তাকে সংশোধনে সহযোগীতা করা। কোমলতা ও প্রেমের সাথে এমনভাবে তার দোষগুলো দেখিয়ে দেয়া যেন সে সংশোধনের সুযোগ পায়। বন্ধু কখনও অন্যের কাছে বন্ধুর দোষ বলতে পারে না বা শুনতে পারে না।এই কাজটা ভালো ঐ কাজটা মন্দ এটা নির্ধারণ করে কে? এই কাজটি করা উচিত ঐ কাজটি করা উচিত নয় কে এই রায় দেয়? উচিত হলে কাজটি করা যাবে অনুচিত হলে করা যাবে না এমন বাধ্যবাধকতা কে আরোপ করে? ভালো-মন্দ নিয়ে বিতর্ক চলে আসছে অনাদি কাল থেকে। ভাল-মন্দ কাকে বলে? কীভাবে আমরা বুঝি কোন্ কাজটি ভাল আর কোন্ কাজটি মন্দ?পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পরিবেশ আমাদের মধ্যে ভালো মন্দের একটি চিত্র তৈরি করে। মনস্তাত্বিকভাবেআমরা সেই চিত্রের মতো হতে চাই। কিন্তু পারি না। আমাদের দৃষ্টিতে মন্দকর্মগুলোকে আমরা ভুল, খারাপ, পাপ ইত্যাদি নানা নামে ডাকি। আমাদের দৃষ্টিতে যা ভালো তা না করে যখন নিজেরাই মন্দ কিছু করে ফেলি তখন সৃষ্টি হয় আত্মগ্লানি ও হতাশার।আমার বিবেক যা করার জন্য সায় দিয়েছে আমি তা করেছি, যা বলার ছিল, বলেছি। যা কিছু আমরা অতীতে করেছি তার কোনকিছুকে পরিবর্তন করার সাধ্য আমাদের নেই। যা করেছি করেছি, এজন্য দুঃখ কিংবা অনুতাপ করে নিজের ক্ষতি ব্যতীত লাভ কিছু হয় না। তবুও ভলো-মন্দের যুদ্ধ থেকে আমাদের পরিত্রাণ নেই। নিজের ভিতরে ভালো-মন্দের যুদ্ধ চলছে তো চলছেই। আমার কাছে যা ভালো তা আমার দৈহিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। আমার কাছে যা মন্দ তা আমার মানসিক ও দৈহিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তবু আমি লোকের অনুমোদন চাই। মানুষের কাছ থেকে আমার কৃত কর্মের অনুমোদন আশা করলে হতাশা তো আসবেই। শান্তি পেতে হলে এসব অমূলক আশা-হতাশা ত্যাগ করতেই তো হবে।কিছু মানুষ আছে যারা ভাল-মন্দ নির্ণয় করে শাস্ত্র থেকে। শাস্ত্রে লিখা আছে এই কাজটি মন্দ সুতরাং তা মন্দ এই হলো তাদের একমাত্র যুক্তি। অন্যদের মতে - মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতা ততক্ষণ পর্যন্ত সমর্থিত যতক্ষণ পর্যন্ত তা অন্য মানুষের ক্ষতির কারণ না হয়। কোন মানুষের কাজ সামাজিক শান্তি ও শৃঙ্খলার জন্য হুমকি না হলেতাকে বাধা দেয়া যায় না। যে যা খুশি করতে পারে কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে তা যেন অন্যের ক্ষতি না করে। অন্যের ক্ষতি না হওয়া পর্যন্ত সব কাজই ব্যক্তি ইচ্ছে করলে করতে পারে। আবার, কিছু মানুষের মানদন্ড হচ্ছে সমাজ। সমাজ যাকে ভাল বলে তাই ভালো আর সমাজ যাকে মন্দ বলে তাই মন্দ। মানুষ সমাজবদ্ধ জীব তাই সমাজ রক্ষার স্বার্থেতাকে সামাজিক রীতি-নীতি মেনে চলতে হয়। তাই সমাজে চালুকৃত প্রথাই অনেকের কাছে ভালো-মন্দের মানদন্ড। সমাজেরকাছে কোন কাজ মন্দ বা অনুচিত বলে বিবেচিত হলে তা অনুচিত। অনেক সময় শাস্ত্রীয় রীতি-নীতিও সমাজের রীতি-নীতিহয়। যাই হোক সমাজের বেশিরভাগ মানুষ যা করছে আমাকেও তা-ই করতে হবে তা না হলেই ‘পাছে লোকে কিছু বলে’ ভয় আমাকে তাড়া করে।এক একটা সমাজের রীতি-নীতি এক এক রকমের। এক সমাজের রীতি-নীতি অন্য সমাজে অচল। এক সমাজের মানদন্ডে অন্য সমাজকে বিচার করা যায় না। অতীতের মানদন্ড দিয়ে যেমন বর্তমানের বিচার করা যায় না তেমনি আরবের মানদন্ড দিয়ে বাংলাদেশের বিচার করা যায় না। এক সমাজের রীতি-নীতিকে অন্য সমাজের রীতি-নীতি থেকে ভালো বা মন্দ বলা যায় না।অনেকের মতে বিবেকই ভালো-মন্দ নির্ধারণের মানদন্ড। তাদের মতে মানুষের মধ্যে এমন একটি শক্তি আছে যা তাকে ভালো কাজ করতে বলে এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকতে বলে। এই শক্তিকে আমরা বলি বিবেক। কিন্তু নিজের মধ্যে অনুসন্ধান করলে উপলব্ধিতে আসে - বিবেকও গঠিত হয় শাস্ত্র পাঠ, শুনা কথা ও সামাজিক রীতি-নীতির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায়। বিবেক ভালোকে ভালো এবং মন্দকে মন্দ বলার আগে তার মানদন্ড তৈরী করে। মানুষের বিবেক স্থান ও কাল ভেদে সব সময় সঠিক সিদ্ধান্ত দিতে পারে না। হঠাৎ করে একজন বাঙালি আমেরিকা গেলে তার বিবেকের কার্যকারীতাহারিয়ে ফেলে। কোন ব্যক্তি নিজের বিবেকের সিদ্ধান্ত অন্য কোন ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা সমাজের উপর চালিয়ে দিতে পারে না। এমন যুক্তি দিয়ে কেউ পার পেতে পারে না যে, আমার বিবেক বলেছে, তাই করেছি। নিজের বিবেকের সিদ্ধান্তঅনুযায়ী মানুষ অন্য ব্যক্তির কর্মের মূল্যায়ন করতে পারে না। দুই ব্যক্তির মধ্যে কোন বিষয়ে দ্বন্দ্ব সৃষ্টিহলে কার বিবেকের সিদ্ধান্ত সঠিক এ বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত নেয়া যায় না। আবার মানুষের বিবেকই অভ্যাসের বশবর্তীহয়ে মন্দকে ভালো এবং ভালোকে মন্দ হিসেবে গ্রহণ করে। বিবেকের আহ্বান শুনলে যদি নিজের কোন পার্থিব ক্ষতির কারণ হয় তাহলে মানুষ যুক্তি দিয়ে বিবেককেও প্রভাবিত করতে পারে। বাস্তবে অধিকাংশ মানুষই বিবেকের নির্দেশে নিজের ক্ষতি করে অন্যের ভাল করে না। বাস্তবে মানুষ মন্দ কাজ থেকে যতটুকু বিরত থাকে তা আইনের ভয়ে। আর আইনেরসীমাবদ্ধতা হলো, আইন কেবল অন্য মানুষের অধিকারে হস্তক্ষেপ করলেই প্রয়োগ হতে পারে। নিজের সাথে নিজে মিথ্যাচার করলে, নিজের সাথে নিজে অঙ্গীকার ভঙ্গ করলে, নিজের সম্পদ নিজে নষ্ট করলে আইন কিছু করতে পারে না। ভালো মানুষ তৈরি করা আইনের উদ্দেশ্য নয়। আইনের উদ্দেশ্য হচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তা। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়াপর্যন্ত আইন কিছু করতে পারে না। আইন মানুষের ঘরে কিংবা নির্জনে পুলিশী পাহাড়া বসাতে পারে না। ভালো-মন্দ নির্ণয়ের এই জটিলতা থেকেই উপলব্ধিতে আসে একজন ভালো বন্ধুর প্রয়োজনীয়তা।ভালোমন্দ নির্ণয় করতে হলে বন্ধুর প্রতি থাকতে হবে প্রেম, শ্রদ্ধা, ভক্তি ও বিশ্বাস। বন্ধুর আদেশ, উপদেশ, নিষেধের প্রতি শ্রদ্ধা, ভক্তি এবং বিশ্বাসই পারে মানুষকে ভালো-মন্দের সঠিক নির্দেশনা দিতে। যে কর্মের মাধ্যমে বন্ধুর সন্তুষ্টি অর্জিত হয় তা ভালো, যে কর্মের মাধ্যমে বন্ধু অসন্তুষ্ট হন তা মন্দ। বন্ধুত্বের অভিধানেএই হলো ভালো-মন্দের সংজ্ঞা।বন্ধুর কাছে মূল্যায়নের একমাত্র মানদন্ড হচ্ছেন বন্ধু। সারা পৃথিবী আমার বিরুদ্ধে চলে যাক্, সব মানুষ আমার সমালোচনা করুক তাতে কী!  বন্ধু সন্তুষ্ট হলে আমিও সন্তুষ্ট হবোো ।

সমাজে বন্ধুত্বের জয় হোক



Saturday, September 23, 2017

তেজ - দেবব্রত সিংহ

                                  তেজ
                          দেবব্রত সিংহ
মু জামবনির কুঁইরি পাড়ার শিবু কুঁইরির বিটি সাঁঝলি বটে।’কাগজওয়ালারা বইললেক,“উঁ অতটুকু বইললে হবেক কেনে?তুমি এবারকার মাধ্যমিকে পত্থম হইছ।তোমাকে বইলতে হবেক আরো কিছু।”পঞ্চায়েতের অনি বৌদি, পধান, উপপধান, এইমেলে, এম.পি-সব একেবারে হামলিয়ে পড়ল আমাদের মাটির কুঁইড়েঘরে।জামবনি ইস্কুলের হেডমাস্টারকোন বিহান বেলায় টিনের আগর খুইলে,হেইকে, ডেইকে, ঘুম ভাঙাই- খবরটা যখন পথম শুনালেকতখন মাকে জড়াই শুয়ে ছিলুম আমি।কুঁড়াঘরের ঘুটঘুইটা আঁধারে হেডমাস্টার মশাইরে দেইখেচোখ কচালে মায়ের পারা আমিও হাঁ – হয়ে ভাইবে ছিলেম।-একি স্বপন দেখছি নাকি-স্যার বইলল, এটা স্বপুন লয়, স্বপুন লয়, সত্যি বইটে।কথাটো শুইনে কেঁইনদে ভাসায়েছিলুম আমরা মা বিটি।আজ বাপ বেঁইচে থাইকলেআমি মানুষটাকে দেখাইতে পাইত্থম। দেখাইতে পাইতত্থেম বহুত কিছু-আমার বুকের ভিতরযে তেজালো সইনঝা বাতিটা জ্বালায়ে ছিল মানুষটা।সেই বাতিটা আজকে কেমন আমাদের কুঁইড়ে ঘরটাকে আলো কইরেছে।সেটো দেখাইতে পাইত্থম।আপনারা বইলছেন বটে“তুমাদের মতো মেইয়ারা যদি উঠে আসে তবে ভারতবর্ষ উঠে আসে।”কথাটা খুবই সত্যি, কিন্তুউঠে আসার রাস্তাটা যে এখোন তৈয়ার হয় নাই।খাড়া পাহাড়ে উঠা যে কি জিনিস।বহুত দম লাগে। বহুত ত্যাজ লাগে…আমি জামবনির কুঁইরি পাড়ার শিবু কুঁইরির বিটি সাঁঝলি।যখন থেকে হুঁশ হইছে তখন থেকে শুইনে আসছি“বিটি না মাটি’ঠাকুমা বইলথক্,পরের ঘরে হেঁইসেল ঠেইলবেক্ তার আবার লিখাপড়া’গাঁয়ের বাবুরা বইলথক্“দ্যাখ সাঁঝলি – মন খারাপ কইরলি তো হেইরে গেলি।শুন যে যা বইলছে বলুক্। সে সব কথা এক কানে সিধালেআর এক কানে বার কইরে দিবি।’তখ্যান বাবুপাড়ার দেঘইরা ঘরে কামিন খাইটতক মা।ক্ষয় রোগের তাড়সে-মায়ের গতরটা ভাঙে নাই অতোটা।মাঝে মইধ্যে জ্বরটর আইত বটে, জ্বর এলে মাচুপচাপ এঙনাতে তালাই পাইতে শুইয়ে থাইকতো।মনে আছে সে ছিল এক জাঁড় কালের সকাল।রোদ উঠেছিল ঝলমলানি ঝিঙা ফুলা রোদ।আমি সে রোদে পিঠ দিয়া গা দুলাই পড়ছিলামইতিহাস…কেলাস সেভেনের সামন্ত রাজাদের ইতিহাস।দে ঘরের গিন্নি লোক পাঠাইছিল বারকতক।মায়ের জ্বর সে তারা শুইনতে নাই চায়!আমাদের দিদি বুঢ়ি তখনো বাঁইচে।ছেঁড়া কম্বল মুড়হি দিয়ে বিড়ি ফুকছিল বুড়হি।শেষতক্ বুড়হি সেদিন পড়া থেকে উঠাইমায়ের কাইজ টুকুন কইরতে পাঠাই ছিল বাবু ঘরে।পুরানো ফটক ঘেরা উঠান-অতোবড়ো দরদালান- অতোবড়ো বারান্দা,সব ঝাঁট ফাট দিয়ে সাফ সুতরো করে আসছিলুম চইলে,দেঘইরে গিন্নি নাই ছাইড়ল্যাক, একগাদা এটাকাটা-জুঠা বাসনআমার সামনে আইনে ধইরে দিলেক। বইল্লুম“আমি তোমাদের জুঠা বাসন ধুইতে লাইরবো,”বাবু গিন্নির সেকি রাগ’-“কি বইল্লি তুই যতবড়ো মু লয় তত বড়ো কথা? জানিস,তর মা, তর মায়ের মা, তার মায়ের মা সবাই এতক্কালআমাদের জুঠা বাসন ধুয়ে গুজারে গ্যালোআর তুই আমাদের জুঠা বাসন ধুইতে লাইরবি!”বল্লুম “হ আমি তোমাদের জুঠা বাসন ধুইতে লাইরবো।তোমরা লোক দেখে লাওগা। আমি চইল্লোম”কথাটো বইলে গটগট গটগট কইরে বাবু গিন্নির মুখের সামনেআমি বেড়োই চইলে আইলম।”তা বাদে সে লিয়ে কি কাইন্ড। কি ঝাম্যালা।বেলা ডুবলে মাহাতোদের ধান কাট্টে বাপ ঘরে ফিরে আইলেদুপাতা লিখাপড়া করা লাত্নির ছোট মুখে বড়ো থুতির কথাসাতকাহন কইরে বইলেছিল বুড়হি দিদি।মা কুনো রা কাড়ে নাই।আঘর মাসের সইন্ ঝা বেলাই এঙ্গ্নাতে আগুন জ্বেইলেগা-হাত-পা সেঁকছিল মা।একমাথা ঝাঁকড়া চুল ঝাঁকানো বাপের পেটানো পাথরের মুখটাঝইলকে উঠেছিল আগুনের আঁচে।আমি বাপের অমুন চেহারা কুনোদিন দেখি লাই।বাপ সেদিন মা আর দিদি বুড়ির সমুখে আমাকে কাইছে ডেইকেমাথায় হাত বুলাই গম্ গইমা গলায় বইলেছিল –যা কইরেছিস্! বেশ্ কইরেছিস্।শুন্, তর মা, তর মায়ের মা, তার মায়ের মা- সবাই কইরেছে কামিনগিরি।বাবুঘরে গতর খাটাই খাইয়েছে। তাইতে হইছে টা কি।তাতে হইছে টা কি! ই-কথাটো মনে রাখবি সাঝ্লি,তুই কিন্তু কামিন হবার লাগে জম্মাস লাই।যত বড় লাট সাহেবই হোক কেনে কারু কাছে মাথা নোয়াইনিজের ত্যাজ বিকাবি লাই।এই ত্যাজ টুকুর ল্যাইগে লিখাপড়া শিখাচ্ছি তুকে।না হলে আমাদের মতো হা-ভাতা মানুষের ঘরে আর আছে টা কি?”আমি জামবনির কুইরি পাড়ার শিবু কুইরির বিটি সাঁঝলি,কবেকার সেই কেলাস সেভেনের কথা ভাবতে যায়েকাগজওয়ালা টিভিওয়ালাদের সামনে এখুন কি যে বলি…তালপাতার রদ দিয়ে ঘেরা গোবুর লতার এঙ্গনাতে লুকে এখন লুকাকার।তার মাঝে বাঁশি বাজাই, জিপগাড়িতে চেইপেআগুপিছু পুলিশ লিয়ে মন্ত্রী আইল্যাক ছুটে।‘কুথায় সাঁঝলি কুইরি কুথায়’, বইলতে বইলতেবন্দুকধারী পুলিশ লিয়ে সুজা আমাদের মাটির কুইড়ে ঘরে,হেডমাস্টার বইললে ‘পনাম কর, সাঁঝলি পনামকর’মন্ত্রী তখন পিঠ চাপড়াইল্যাক। পিঠ চাপরাই বইল্লেক,“তুমি কামিন খেইটে মাইধ্যমিকে পথম হইছ,তাই তুমারে দেইখতে আইলম্, সত্যিই বড় গরীব অবস্থা বটে।তুমাদের মতো মিয়ারা যাতে উঠে আসেতার লাগেই তো আমাদের পার্টি, তার লাগেই তো আমাদের সরকার।– এই লাও, দশ হাজার টাকার চেকটা এখুন লাও।শুন আমরা তুমাকে আরো ফুল দিব, সম্মর্ধ্বনা দিব,আরো দ্যাদার টাকা তুলে দিব।–এই টিবির লোক, কাগুজের লোক, কারা আছেন, ই-দিকে আসেন।“তক্ষুনি ছোট বড় কতরকমের সব ঝইলকে উঠল ক্যামেরা,ঝইলকে উঠল মন্ত্রীর মুখ। না না মন্ত্রী লয়, মন্ত্রী লয়,ঝইলকে উঠল আমার বাপের মুখ।গন্ গনা আগুনের পারা আগুন মানুষের মুখ।আমি তক্ষুনি বইলে উঠলম-“না না ই টাকা আমার নাই লাইগব্যাক। আর আপনারাযে আমায় ফুল দিব্যান, সম্মর্ধ্বনা দিব্যান বইলছেন তাও আমার নাই লাইগব্যাক।’মন্ত্রী তখন ঢোক গিলল্যাক।গাঁয়ের সেই দেঘইর্যা গিন্নির বড় ব্যাটা এখুন পাটির বড় ল্যাতা।ভিড় ঠেলে সে আইসে বইলল্যাক-“ ক্যানে, কি হইছেরে সাঁঝলি,তুই তো আমাদের বাড়ি কামিন ছিলি।বল তর কি কি লাইগব্যাক, বল, তর কি কি লাইগব্যাক খুলে বল খালি,”বইল্ লম –“ আমার পারা শয়ে শয়ে আর অনেক সাঁঝলি আছে।আর শিবু কুইরির বিটি আছে গাঁ গিরামে। তারা যদ্দিনঅন্ধকারে পইড়ে থাইকবেক তারা যদ্দিন লিখ-পড়ার লাগে কাঁইদে বুলব্যাক্।তদ্দিন কুনো বাবুর দয়া আমার নাই লাইগব্যাক্। শুইনছ্যান আপনারাতদ্দিন কুনো বাবুর দয়া আমার নাই লাইগ্ ব্যাক।“

জন্মদিন - শুভ দাসগুপ্ত

আজ পয়লা শ্রাবণ।খোকন, আজ তোর জন্মদিন।তুই যখন জন্মেছিলি, আমরা তখন যাদবপুরেনতুন গড়ে ওঠা কলোনীর টালির ঘরেতোর ইস্কুল মাস্টার বাবাসেই হ্যারিকেনের আলো জ্বলা ঘরেইআনন্দে আর খুশিতে ঝলমলে হয়ে উঠেছিলেনতুই আসার পর। তোর নাম রেখেছিলেন-সুকল্যাণ।মানুষটার মনটা ছিল শিশুর মতনঅভাবে অনটনে, বেঁচে থাকার নানা দুর্বিপাকেওভেঙ্গে পড়তেন না কখনও। সকলের ভালচাইতেন মন থেকে।বলতেন দেখো একদিন এই দেশের মানুষঠিক খুঁজে পাবে মুক্তির পথ। শোষণথেকে মুক্তিদারিদ্র থেকে মুক্তি অশিক্ষা থেকে মুক্তি…আজ পয়লা শ্রাবণখোকন, আজ তোর জন্মদিন।ছোটবেলায়, তোর মনে আছে? আমাদের ভাঙ্গা মেঝেতেবাক্স থেকে বার করা মেজো-মাসীর হাতে তৈরি আসনটাপেতে দিতাম। সামনে রাখতাম ঠাকুরের আসনের প্রদীপখানা।তুই বসতিস বাবু হয়ে চুপটি করে।তোকে আমরা একে একে ধান দুব্বো মাথায় দিয়ে আশীর্বাদ করতাম।বাবা বলতেন বড় হও মানুষ হও।তোর বাবার সেই বন্ধু-ঘোষ কাকা তিনি বলতেনবেঁচে বর্তে থাকো।তুই জিগ্যেস করতিস-মা, বর্তে মানে কি মা?আমি শুধু তোর মাথায় ধান-দুব্বোই দিতাম।বলতাম না কিছুই। শুধু মনে মনে বলতামঠাকুর, আমার খোকনকে মস্ত বড় মানুষ করে তোলোআমার খোকন যেন সত্যিই মানুষ হয়।ওর যেন কখনো কোনো বিপদ না হয় ঠাকুর।অভাবের সংসারে ওই একটা দিন-পয়লা শ্রাবণকষ্টের পয়সায় একটু বাড়তি দুধ নিতাম।পায়েস রান্না করে দিতাম তোকে।তুই খুব ভালবাসতিস পায়েস খেতে।তোর বাবা বাসস্টান্ডের দোকান থেকে নিয়ে আসতেনতোর প্রিয় মিষ্টি ছানার গজা।সামান্য ইস্কুল মাস্টারিতে কীই বা আয় হত;ঘরে বসে ছাত্র পড়িয়ে আসতো কিছু।দাউ দাউ অভাবের আগুনে সে রসদ পুড়তে সময় লাগত না।তোর বাবার জামা সেলাই করতাম আর বার বার বলতামআসছে মাসে একটা জামা বানিয়ে নিও।উনি হেসে উঠে বলতেন; বাদ দাও তো,খোকন বড় হচ্ছে।ওর জন্য ভাবছি দুধ রাখতে হবে আরোআধসের-দুধে শক্তি বাড়ে। বুদ্ধি বাড়ে। শক্তি আরে বুদ্ধি না হলেতোমার খোকন মস্ত বড় মানুষ হয়ে উঠবে কি করে?ভাবছি আরো দুটো টিউশনি নেব।ছাত্র পড়িয়ে পড়িয়ে মানুষটা দিনেরশেষে ক্লান্ত হয়ে যেতেন।বারান্দার ধার ঘেঁষে যখন রাতের অন্ধকারে জোনাকির ব্যস্ততা,আর ঘরে তোর পড়া মুখস্থ করার একটানা সুরআমাদের কলোনীর ভাঙ্গাচূড়া বাড়িটাকে জীবন্ত করে রাখতো-তখন বলতেন আমায়; খাওয়া দাওয়া একটু করো- তোমার চেহারাটাবড় ভেঙ্গে পড়ছে দিন দিন… শাড়িটাও তো দেখছি বেশ ছিঁড়েছে-কালই আমি ফেরার পথে একটা শাড়ি নিয়ে আসব। ধারেই আনব।আমি বলতাম-ধুর। সামনে খোকনের উঁচু ক্লাস-কত বই পত্তর কিনতে হবে- কত খরচ।উনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে যেতেন।জোনাকিরা নিঃশব্দ অদৃশ্য আলোর আলপনা আঁকতউঠনের আগাছার ঝোপে।আবহ সঙ্গীতের মত তুই ভেতরে বসে বসে পড়া মুখস্থ করতিস।ইতিহাস, ভূগোল, গ্রামার।ঈশ্বর আমাদের নিরাশ করেননি।তুই কত বড় হলি।সব পরীক্ষায় কত ভাল ফল হল তোর।বাবা বললেন; আরও পড়। উচ্চ শিখাই উচ্চ সম্মানেরএক মাত্র পথ। তুই আরও পড়লি।তারপর…তোর চাকরি হল কত বড় অফিসেমনে আছে খোকা? প্রথম মাসের মাইনে হাতে পেয়েইতুই কত কী কিনে এনেছিলি?তখন তো আমরা উঠে এসেছি শ্যামবাজারে।দু’কামরার বেশ সাজানো ঘোচানো গোছানো বড় ফ্লাট।তোর অফিস থেকেই তো দিয়েছিল।সেই বাড়ি সেই ঘর সেই বেলকনি- কত স্মৃতি- কত ছবি!ঐ বাড়িতেই তোআশ্বিনের ঝড়ো বিকেলে- তোর মনে আছে খোকন?তোর বাবা যেদিনটাতে চলে গেলেন- মনে আছে?তুই বাবার বুকের ওপর পড়ে যখন কাঁদছিলি হাপুস নয়নেসদ্য স্বামীহারা, আমি সেদিন তোর সেই অসহায় মুখ দেখেআরো বেশি করে ভেঙ্গে পড়েছিলাম।তোকে বুকে টেনে নিয়েছিলাম ছোটবেলার মত।বলেছিলাম-কাঁদিস না খোকা। আমিতো আছি।আজ পয়লা শ্রাবণকলকাতা থেকে অনেক দুরে মফস্বলের এই বৃদ্ধাশ্রমেআমি একেবারে একা, খোকন।তোকে বড় দেখতে ইচ্ছে করছে রে।তোকে, বৌমাকে আর ছোট্ট বিল্টুকে।তোরা এখন কত দুরে-সল্ট-লেকের মার্বেল বসানো ঝকঝকে বাড়িতে।আজ তোর জন্মদিনের নিশ্চয়ই খুব বড়পার্টি হচ্ছে-তাই নারে খোকন? লোকজন, হৈচৈ, খাওয়া-দাওয়া।খুব ভাল, খুব ভাল।খোকন, আজ পয়লা শ্রাবণআমার বড় মনে পড়ছে যাদবপুরের ভাঙ্গা ঘরে রাত্রেতুই আমার পাশে শুয়ে মাঝে মধ্যে হঠাৎ খুব ভয় পেয়েজড়িয়ে ধরতিস আমাকে। আমি বলতাম, ভয় কী রে?আমি তো আছি। মা তো আছে খোকনের। যার মা থাকেতাকে কী ভুতে ধরে?তুই নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়তিস আমার বুক জুড়ে।তোর আধুনিক সংসারেএই বুড়িটার একটু ঠাই হল নারে?প্রতিমাও তো মা। ওরও তো আছে আমারখোকনেরই মতকোল আলো- করা এক চাঁদের টুকরো।কিন্তু সময়ের কী আশ্চর্য পরিবর্তন!খোকন!তুই বোধহয় আর এখন পায়েস খাস না- তাই নারে?তুই জানিস না খোকনআজ আমি সকালে পায়েস রান্না করেছি। হ্যাঁতোরই পাঠানো টাকায়।সারাদিন সেই পায়েসের বাটি সামনে নিয়ে বসে আছি রে।এখানে এই বৃদ্ধাশ্রমেআমার একলা ঘরেআর কেউ নেই।তুই একবার আসবি খোকন।একবার.. শুধুএকবার।

Tuesday, September 19, 2017

ভাই ফোঁটা উৎসব কেন করা হয়?

পুরাণে উল্লেখ আছে- কার্তিকেয় শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে যমুনাদেবী তাঁর ভাই যমের মঙ্গল কামনায় গভীর ধ্যানমগ্ন হয়ে পুজা করেন। তাঁরই পুণ্যপ্রভাবে যমদেব অমরত্ব লাভ করেন। বোন যমুনা দেবীর পুজার ফলে ভাই যমের এই অমরত্ব লাভের চেতনায় উদ্ভুদ্ধ হয়ে বর্তমান কালের বোনেরাও এই সংস্কার বা ধর্মাচার পালন করে আসছে।

এই দিন বোনেরা উপবাস রেখে ভাইয়ের কপালে বাঁ হাতের অনামিকা আঙ্গুল দিয়ে চন্দন, ঘি, কাজল, মধু , শিশির, গোমূত্র দিয়ে ফোঁটা দিয়ে ভাইয়ের দীর্ঘায়ু কামনা করে থাকে।

সাধারণত এই সময় বোনেরা যে মন্ত্রটি পাঠ করে –

“ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা,
যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা।
যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা,
আমি দেই আমার ভাইকে ফোঁটা।”

দ্রোপদীর পাঁচ স্বামী কেন?

দ্রৌপদী এ সমাজের মেয়েদের মতো কোনও সাধারণ মেয়ে ছিলেন না। দ্রুপদ রাজার যজ্ঞের অগ্নি থেকে তাঁরজন্ম হয়েছিল। পূর্বজন্মে তিনি এক ঋষিরকন্যা ছিলেন। অতি কঠোর তপস্যা করেতিনি শিবের প্রীতি সাধন করেছিলেন। তখন প্রসন্ন হয়ে শিব তাঁকে বর দিতে চাইলে তিনি করজোড়ে শিবের কাছে পতি লাভের বাসনা ব্যাক্ত করেন। “হে মহাদেব, যদি প্রসন্ন হয়ে থাকেন, তবে যাতে আমি সর্বগুণ সম্পন্ন পতি লাভে চরিতার্থ হতে পারি, এরূপ বর প্রদান করুন।' এই কথা পাঁচবার উচ্চারণ করেন এবং প্রতিবারই শিব ‘তথাস্তু’বলেছিলেন। তারপর শিব বলেন,“হেকন্যা,তুমি পাঁচবারই পতি বাসনা করেছ, তাই পরজন্মে রাজকন্যা রূপে জন্ম নিয়ে দেবগুন সম্পন্ন পঞ্চপতি লাভ করবে।

”তারপর পরজন্মে সেই ঋষিকন্যা মহর্ষিউপযাজ কৃত যজ্ঞ থেকে উত্থিতা হন। দ্রুপদ রাজার কন্যারূপে তিনি দ্রৌপদী নামে আখ্যাতা হন। তারপর তাঁর পঞ্চপতি হওয়ার ঘটনাটিও ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিগণ সমর্থন করেছেন ।

হিন্দুরা মৃত দেহ পুড়িয়ে ফেলে কেন?

প্রায়ই আপনার মুসলমান বন্ধুদের কাছে আপনাকে একটি প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় – হিন্দুরা কেন মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলে? কবরও তো দিতে পারতো বা অন্যকিছু করতে পারতো। পুড়িয়ে ফেলা কি অমানবিক নয়?

আমাদের অজ্ঞতার কারণে আমরা প্রশ্নটির সঠিক উত্তর দিতে ব্যর্থ হই। প্রথমে যে ইনফরমেশনটি আপনার জানা প্রয়োজন তা হলো পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি মানুষ হিন্দু-বৌদ্ধ রীতি অনুসরণ করে অর্থাত মৃতদেহ পুড়িয়ে সৎকার করে।

পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত জাতি জাপান থেকে শুরু করে চীন, কুরিয়া, ভারত ও অন্যান্য জাতি এই রীতি অনুসরণ করে। তাহলে আপনি প্রথমত: পাল্টা প্রশ্ন করতে পারেন :

১. পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত জাতি জাপানিরা কি তাহলে অমানবিক ? পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ কি অমানবিক ? যদি এই অর্ধেক মানুষ অমানবিক হয় তবে এদের মধ্যে কেন আমরা সবচেয়ে কম হানাহানি দেখতে পাই ? আসুন এবার প্রকৃত উত্তরের দিকে যায়।

১. হিন্দুধর্মে কবর দেয়া বা সমাধি দেয়া নিষিদ্ধ নয়। স্মৃতিশাস্ত্রে স্পষ্টভাবেই এটা অনুমোদিত। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মাঝে এখনও এটা প্রচলিত আছে। যেমন- নাথ বা যোগী সম্প্রদায় এবং সন্ন্যাসীদেরকে সমাধি দেয়া হয়। অনেক জায়গায় দেখা যায় কারও অপমৃত্যু হলে তার শব সমাধি দেয়া হয়, পোড়ানো হয় না।

২. আমরা কথ্য ভাষায় ‘লাশ পোড়ানো’ বলি, কিন্তু শাস্ত্রীয় ভাষায় এটা ‘অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া’। এটা আবার কী? অন্ত+ইষ্টি=অন্ত্যেষ্টি। ইষ্টি মানে যজ্ঞ। অন্ত্যেষ্টি হলো জীবনের শেষ যজ্ঞ।

আমরা জানি, আমাদের সুপ্রাচীন পূর্বপুরুষদের বৈদিক সমাজ ছিল যজ্ঞপ্রধান। জীবনের শুরু ‘গর্ভাধান’ থেকে জীবনের শেষ ‘দেহত্যাগ’ সবই হতো ঈশ্বরকে উদ্দেশ্য করে। জীবৎকালে প্রতিদিনই পঞ্চমহাযজ্ঞ করতে হতো (এখনও করার বিধান)। এছাড়া অগ্নিহোত্র যজ্ঞের মতো বিবিধ যজ্ঞে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে ‘হবি’ (বর্তমানে পূজায় অর্ঘ্য নিবেদনের মতো) উৎসর্গ করা হতো। এ হলো ঈশ্বরের দেয়া জীবন ও দেহ দ্বারা ঈশ্বরের সৃষ্ট প্রকৃতির উপাদানসমূহ ভোগ করার প্রেক্ষিতে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে কৃতজ্ঞতাপূর্বক তাঁর উপাসনা করা। তাই অন্ত্যেষ্টি তথা জীবনের শেষ যজ্ঞে ঈশ্বরপ্রদত্ত এই দেহখানি ঈশ্বরের উদ্দেশ্যেই ‘হবি’ বা অর্ঘ্যরূপে উৎসর্গ করা হয়। এটা সত্যিই চমৎকার একটা ব্যাপার!

৩. প্রাচীন দর্শন অনুযায়ী বিশ্বচরাচর তথা আমাদের দেহও পাঁচটি ভূত বা উপাদান দ্বারা তৈরি। একে ‘পঞ্চভূত’ বলে। এগুলো হলো- ক্ষিতি (মাটি), অপ (জল), তেজ (আগুন), মরুৎ (বাতাস), ব্যোম (আকাশ বা শূন্যস্থান)। যারা বলেন ‘মাটির দেহ’ বা দেহ শুধু মাটি দিয়ে তৈরি, তাই একে মাটির সাথেই মিশিয়ে দেয়া উচিৎ, তারা অবশ্যই ভুল বলেন। বাস্তবে দেহ এই পাঁচটি উপাদানের সমষ্টি। শবদাহ করার মাধ্যমে দেহকে এই ৫টি উপাদানেই মিশিয়ে দেয়া হয় প্রত্যক্ষভাবে। দাহ শেষে অবশিষ্টাংশ জলে বিসর্জন দেয়া হয়। এজন্য শ্মশান সর্বদাই জলাশয়ের পাশে হয়ে থাকে। অপরদিকে সমাধি বা কবর দিলে দেহ পঞ্চভূতে লীন হয় বটে, তবে পরোক্ষ ও ধাপে ধাপে। কারণ দেহ মাটির সাথে মেশে পঁচন প্রক্রিয়ায়। কোটি কোটি অনুজীব, পোকা-মাকড়ের খাবারে পরিণত হয় দেহ। এভাবে পঁচে গলে মাটিতে মেশানোই বরং দাহ করার চেয়ে বেশি অমানবিক মনে হয়। একটা মজার তথ্য দিই। অনেক সময় আমরা বলি, লোকটা তো মরে ভূত হয়ে গেছে। প্রকৃতপক্ষে সে প্রকৃতিতে (পঞ্চভূতে) লীন হয়েছে -এটাই বুঝতে হবে।

৪. মৃত্যু হয় দেহের; আত্মার নয়। অবিনাশী আত্মা অজর, অমর, অক্ষয়, অব্যয়। এটা জগদীশ্বর পরমাত্মার অংশ। (‘বিদ্রোহী’ কবিতার কয়েক লাইন মনে পড়ে কি?) জড় প্রকৃতির পঞ্চভূতে গড়া দেহ ফিরে যায় পঞ্চভূতে, আর জীবাত্মা ফিরে যায় পরমাত্মাতে। (মৃত্যুর পরে অবশ্যই আর কখনোই আপনি পুরনো দেহে ফিরে আসবেন না, বা কোন প্রকার শাস্তি/আজাব ভোগ করবেন না। শবদাহ করার পরে/মাটিতে মিশে যাওয়ার পরে নিশ্চয়ই লীন হওয়া দেহকে শাস্তি/আজাব যৌক্তিকভাবে সম্ভব নয়।)

৫. মৃত্যু প্রকৃতপক্ষে শোকের কোন ব্যাপার নয়। তীর্থস্থান বেনারস বা কাশীতে মৃত্যুও একটা উৎসবের ব্যাপার।

“জাতস্য হি ধ্রুবর্মৃত্যো 
ধ্রুবং জন্ম মৃতস্য চ”-গীতা।
যে জন্মেছে তার মৃত্যু নিশ্চিত, যে মরেছে তার জন্মও নিশ্চিত।

অতএব, দেহান্তরের নিছক সাধারণ ঘটনায় শোক কেন? বরং জরাজীর্ণ রোগশোকে আক্রান্ত দেহ ছেড়ে জীবাত্মার নতুন সুস্থ-সুন্দর দেহে জীবন আরম্ভের প্রাক্কালে মৃতকে হাসিমুখে শুভেচ্ছা জানানোই উচিত।

একটি " জগন্নাথপুর শিক্ষা ফাউন্ডেশন"

জগন্নাথপুর শিক্ষা ফাউন্ডেশন একটি অলাভজনক সেবা প্রতিষ্টান। উক্ত গ্রামের হতদরিদ্র ছাত্রছাত্রীদের বিনা খরচে শিক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা ও আর্...