বারো মাসে তের পর্বণ কথাটি
হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য প্রচলিত
থাকলেও শারদীয়া বা দূর্গা
পূজাই বেশি আনন্দ উৎসবের
মাধ্যমে পালন করা হয়।
দেবী দূর্গা হলেন শক্তির রূপ,
তিনি পরব্রহ্ম। অনান্য দেব
দেবী মানুষের মঙ্গলার্থে তাঁর
বিভিন্ন রূপের প্রকাশ মাত্র।
হিন্দু ধর্মশাস্ত্র অনুসারে দেবী
দূর্গা ‘দূর্গতিনাশিনী’ বা সকল
দুঃখ দুর্দশার বিনাশকারিনী।
পুরাকালে দেবতারা
মহিষাসুরের অত্যাচারে স্বর্গ
থেকে বিতাড়িত হয়েছিল।
ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর’র শরীর
থেকে আগুনের মত তেজরশ্মি
একত্রিত হয়ে বিশাল এক
আলোক পূঞ্জে পরিণত হয়। ঐ
আলোক পুঞ্জ থেকে আর্বিভূত
এক দেবী মূর্তি। এই দেবীই
হলেন দুর্গা। দিব্য অস্ত্রে
সজ্জিত আদ্যাশক্তি মহামায়া
অসুর কুলকে একে একে বিনাশ
করে স্বর্গ তথা বিশ্ব
ব্রহ্মাণ্ডে শান্তি স্থাপন
করেন।
দেবী দূর্গা ত্রি-নয়না বলে
তাঁকে ‘ত্রৈম্বক্যে’ বলা হয়।
তাঁর বাম চোখ হলো বাসনা
(চন্দ্র), ডান চোখ কর্ম (সূর্য) ও
কেন্দ্রীয় চোখ হলো জ্ঞান
(অগ্নি)। দূর্গার দশ বাহুতে যে
দশটি অস্ত্র রয়েছে, সেই
অস্ত্রসমূহও বিভিন্ন প্রতীকের
ইঙ্গিতবাহী। শঙ্খ ‘প্রণব’ বা
ওঙ্কার ধ্বনির অর্থবহতা
নির্দেশ করে। তীর ধনুক দেবীর
শক্তিমত্তার প্রতীক। মায়ের
হস্তে ধৃত বজ্রাগ্নি হলো
ভক্তের সঙ্কল্পের দৃঢ়তা।
দূর্গা’র হাতের পদ্ম বা ‘পঙ্কজ’
অর্থ হলো পদ্ম যেমন
কাদামাটির ভেতর হতে
অনাবিল হয়ে ফোটে, তেমনি
দেবীর উপাসকরাও যেন লোভ-
লালসার জাগতিক কাদার
ভেতর হতে আত্মার বিকাশ
ঘটাতে পারে। দেবীর
তর্জনীতে ধরা সুদর্শন চক্র তাঁর
শুভতার লালন ও অশুভের
বিনাশের ইচ্ছার প্রকাশ।
দূর্গার হাতে ধরা তলোয়ার
জ্ঞানের ইঙ্গিত ও ত্রিশুল হলো
সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ গুণের
প্রকাশ। হিন্দু শাস্ত্র মতে,
দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও ভয়-
শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা
করেন, তিনিই দুর্গা।
দূর্গা পূজা কবে, কখন, কোথায়
প্রথম শুরু হয়েছিল তা জানা
যায় না। ভারতের দ্রাবিড়
সভ্যতায় মাতৃতান্ত্রিক
দ্রাবিড় জাতির মধ্যে
মাতৃদেবীর পূজার প্রচলন ছিল।
সিন্ধু সভ্যতায় (হরপ্পা ও
মহেঞ্জোদারো সভ্যতা)
দেবীমাতা, ত্রিমস্তক দেবতা,
পশুপতি শিবের পূজার প্রচলন
ছিল। দূর্গা শিবের
অর্ধাঙ্গিনী সে হিসাবে
অথবা দেবী মাতা হিসাবে
পূজা হতে পারে। তবে
কৃত্তিবাসের রামায়নে আছে,
শ্রী রাম চন্দ্র কালিদহ সাগর
(বগুড়ার) থেকে ১০১ টি নীল
পদ্ম সংগ্রহ করে সাগর কূলে
বসে বসন্তকালে সীতা
উদ্ধারের জন্য সর্বপ্রথম শক্তি
তথা দুর্গোৎসবের (বাসন্তি
পূজা বা অকাল বোধন) আয়োজন
করেছিলেন। মারকেন্দীয়া
পুরান মতে, চেদী রাজবংশের
রাজা সুরাথা খ্রীষ্ট্রের
জন্মের ৩০০ বছর আগে কলিঙ্গে
(বর্তমানে উরিষ্যা) নামে
দূর্গা পুজা প্রচলন করেছিল।
যদিও প্রাচীন উরিষ্যার সাথে
নেপালের পূজার কোন যোগসূত্র
আছে কিনা জানা নাই।
ইতিহাস থেকে যতটুকু জানা
যায় মধ্য যুগে বাংলা
সাহিত্যে দূর্গা পূজার অস্তিত্ব
পাওয়া যায়। ১১শ শতকে
অভিনির্ণয়-এ, মৈথিলী কবি
বিদ্যাপতির
দূর্গাভক্তিতরঙ্গিনীতে দূর্গা
বন্দনা পাওয়া যায়। বঙ্গে ১৪শ
শতকে দুর্গা পূজার প্রচলন ছিল
কিনা ভালভাবে জানা যায়
না। ১৫১০ সালে কুচ বংশের
রাজা বিশ্ব সিংহ কুচবিহারে
দূর্গা পূজার আয়োজন
করেছিলেন। ১৬১০ সালে
কলকাতার বারিশার রায়
চৌধুরী পরিবার প্রথম দূর্গা
পূজার আয়োজন করেছিল বলে
ধারণা করা হয়। ১৭৯০ সালের
দিকে এই পূজার আমেজে
আকৃষ্ট হয়ে পশ্চিম বঙ্গের হুগলি
জেলার গুপ্তি পাড়াতে বার
জন বন্ধু মিলে টাকা পয়সা
(চাঁদা) তুলে প্রথম সার্বজনীন
ভাবে আয়োজন করে বড়
আকারে দূর্গা উৎসব। যা
বারোইয়ার বা বারবন্ধুর পূজা
নামে ব্যাপক পরিচিতি পায়।
আধুনিক দূর্গা পূজার প্রাথমিক
ধাপ ১৮ম শতকে নানা বাদ্য
যন্ত্র প্রয়োগে ব্যক্তিগত,
বিশেষ করে জমিদার, বড়
ব্যবসাযী, রাজদরবারের রাজ
কর্মচারী পর্যায়ে প্রচলন ছিল।
পাটনাতে ১৮০৯ সালের দূর্গা
পূজার ওয়াটার কালার ছবির
ডকুমেন্ট পাওয়া গেছে।
উরিষ্যার রামেশ্বরপুরে একই
স্থানে ৪০০ শত বছর ধরে সম্রাট
আকবরের আমল থেকে দূর্গা
পূজা হয়ে আসছে। ১৯১০ সালে
সনাতন ধর্মউৎসাহিনী সভা
ভবানীপুরে বলরাম বসু ঘাট
লেনে এবং একই জেলায়
অন্যান্যরা রামধন মিত্র লেন,
সিকদার বাগানে একই বছরে
ঘটা করে প্রথম বারোয়ারী
পুজার আয়োজন করে।
ভারতের স্বাধীনতা
আন্দোলনে দূর্গা স্বাধীনতার
প্রতীক হিসাবে জাগ্রত হয়।
বিংশ শতাব্দির প্রথমার্ধে এই
পূজা ঐতিহ্যবাহী বারোয়ারী
বা কমিউনিটি পূজা হিসাবে
জনপ্রিয়তা লাভ করে। আর
স্বাধীনতার পর এই পূজা
পৃথিবীর অন্যতম প্রধান উৎসবের
মর্যাদা পায়।
সরকারি বা জাতীয়ভাবে এই
উৎসবকে দূর্গা পূজা বা দূর্গা
উৎসব হিসাবে অভিহিত করা
হয়। দক্ষিণ এশিয়ায় এটাকে
শরৎ কালের বার্ষিক মহা উৎসব
হিসাবে ধরা হয় বলে একে
শারদীয় উৎসবও বলা হয়।
কার্তিক মাসের ২য়দিন থেকে
৭ম দিন পর্যন্ত এই উৎসবকে
মহালয়া, ষষ্ঠি, মহাসপ্তমী,
মহাঅষ্টমী, মহানবমী ও দশমী
নামে পালন করা হয়। অকালে
বা অসময়ে দেবীর আগমন বা
জাগরণ বলে বসন্তকালের এই
উৎসবকে বাসন্তি পূজা বা
অকালবোধনও বলা হয়।
দূর্গা পূজা ভারতে অসম, বিহার,
ঝাড়খন্ড,উড়িষ্যা ও
পশ্চিমবঙ্গে ব্যাপকভাবে
উৎযাপন করা হয়। সেখানে ৫
দিনের ছুটি ঘোষণা করা হয়।
পশ্চিম বঙ্গ ও ত্রিপুরায়
(যেখানে বাঙালি হিন্দুরা
ব্যাপক সংখ্যায় বসবাস করে)
সবচেয়ে বড় সামাজিক, ধর্মীয়
উৎসব হিসাবে পালিত হয়। এ
ছাড়াও পূর্ব ভারতের বা পশ্চিম
বঙ্গের কলকাতা, হুগলী,
শিলিগুড়ি, কুচবিহার, লতাগুড়ি,
বাহারাপুর, জলপাইগুড়ি এবং
ভারতের অন্যান্য অঞ্চল যেমন,
আসাম, বিহার, দিল্লী, উত্তর
প্রদেশ, মহারাষ্ট্র, গোয়া,
গুজরাট, পাঞ্জাব, কাশ্মীর,
অন্ধ্র প্রদেশ, কর্ণাটক,
তামিলনাড়–, কেরালায় ঘটা
করে এই উৎসব পালন করা হয়।
নেপালে ও ভুটানেও স্থানীয়
রীতি-নীতি অনুসারে প্রধান
উৎসব হিসাবে পালন করা হয়।
বাংলাদেশের সাতক্ষীরার
কলারোয়ার ১৮ শতকের
মঠবাড়িয়ার নবরতœ মন্দিরে
(১৭৬৭) দূর্গা পূজা হত বলে
লোকমুখে শোনা যায়।
ঢাকেশ্বরী মন্দির চত্বরে আছে
দুই ধরনের স্থাপত্যরীতি
মন্দির। প্রাচীনতমটি পঞ্চরতœ
দেবী দূর্গার যা সংস্কারের
ফলে মূল চেহেরা হারিয়েছে।
মন্দিরের প্রাচীন গঠনশৈলী
বৌদ্ধ মন্দিরের মত। ধারণা করা
হয়, দশম শতকে এখানে বৌদ্ধ
মন্দির ছিল যা পরে সেন আমলে
হিন্দু মন্দির হয়েছিল এবং ১১শ
বা ১২শ শতক থেকে এখানে
কালী পূজার সাথে দূর্গা
পূজাও হত।
ইতিহাসবিদ দানীর মতে, প্রায়
সাড়ে পাঁচশো বছর আগে রমনায়
কালী মন্দির নির্মিত হয়েছিল
এবং এখানেও কালী পূজার
সাথে দূর্গা পূজাও হত।
Monday, September 18, 2017
দূর্গার হাতে কিসের প্রতীক তা বর্ণনা?
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
একটি " জগন্নাথপুর শিক্ষা ফাউন্ডেশন"
জগন্নাথপুর শিক্ষা ফাউন্ডেশন একটি অলাভজনক সেবা প্রতিষ্টান। উক্ত গ্রামের হতদরিদ্র ছাত্রছাত্রীদের বিনা খরচে শিক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা ও আর্...
-
আর পারছি না গুরু তেইশটা বছর ধরেপ্যান্টে শার্ট গুজে পরে আর পারছিনা গুরুসেই নার্সারি থেকে শুরু। পাড়ার যত ছেলেগুলোসবার ঘরে বউ এল মা বললেন ম...
-
বাসর ঘরে ঢুকতেই বউ আমাকে নমস্কার জানালো।আমিও নমস্কার উত্তর শুনে পাশে গিয়ে বসলাম। পাশে বসতেই বৌ আমাকে বলল.... ----ঘড়িতে তাকিঁয়ে দেখুন তো...
-
আকাশে এখন ছেঁড়া মেঘের ভেলা। শহরের ইতিউতি কোথাও যেন কাশ ফুলের দেখা পাওয়া। আর ভোরবেলা শিউলির ফুলের গন্ধ। দিকে দিকে এখন দেবী বন্দনা। বছর ঘু...
No comments:
Post a Comment